চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন চলে গেলেন

জেসমিন পাপড়ি
2018.12.14
ঢাকা
181214_Amzad_hossain_620.jpg চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন। ফাইল ছবি।
[নিউজরুম ফটো]

না ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী ও লেখক আমজাদ হোসেন।

শুক্রবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা ৫৭ মিনিটে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন চলচ্চিত্র নির্মাতা এসএ হক অলিক।

আমজাদ হোসেনের বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। স্ত্রী আর চার ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন তিনি।

আমজাদ হোসেনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।

শোকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, “বরেণ্য এই শিল্পীর মৃত্যুতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো। স্বীয় কর্মের মাধ্যমে মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি।”

সংস্কৃতিমন্ত্রী তাঁর শোকবার্তায় বলেন, “একুশে পদক বিজয়ী আমজাদ হোসেনের মৃত্যুতে দেশ একজন ক্ষণজন্মা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিকে হারালো। তিনি ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, পরিচালক, লেখক ও অভিনেতা।”

গত ১৮ নভেম্বর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আমজাদ হোসেনকে। সেখানে শুরু থেকেই কৃত্রিম উপায়ে শ্বাসপ্রশ্বাস দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয় তাঁকে। পরিস্থিতির একটু উন্নতি হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায় উন্নত চিকিৎসার জন্য আমজাদ হোসেনকে থাইল্যান্ডে নেওয়া হয়।

একুশে পদক বিজয়ী আমজাদ হোসেন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মাথায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। তাঁর উন্নত চিকিৎসার খরচ বাবদ ২০ লাখ টাকা এবং এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া বাবদ ২২ লাখ টাকা পরিবারের হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।

গত ২৭ নভেম্বর মধ্যরাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ব্যাংককে নিয়ে বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে।

প্রখ্যাত এই চলচ্চিত্র নির্মাতার মরদেহ দেশে কখন আনা হবে সে বিষয় এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন তাঁর বড় সন্তান সাজ্জাদ হোসেন দোদুল।

তিনি বলেন, বাবাকে কখন দেশে আনা হবে সে বিষয়ে আলোচনা চলছে।

শোকে বিহবল চলচ্চিত্র অঙ্গন

আমজাদ হোসেনের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে চলচ্চিত্র তথা সমগ্র সাংস্কৃতিক অঙ্গনে।

তাঁর পরিচালিত অনেক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেন নায়িকা ববিতা। আমজাদ হোসেনের মৃত্যুর খবর তাঁকে মর্মাহত করেছে জানিয়ে বেনারকে বলেন, “আমার ক্যারিয়ারের বিরাট অংশ আমজাদ হোসেনকে জুড়ে। আমজাদ ভাইয়ের সব ভালো ভালো ছবিতে আমি কাজ করেছি।”

“উনি যে ছবিগুলো বানিয়েছিলেন, সব বাংলাদেশের মাইলস্টোন ছিল। তাঁর ছবিগুলো মস্কো, তাসখন্দ, দিল্লী প্রভৃতি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিল এবং ভীষণ প্রসংশিত হয়েছিল, পুরস্কারও পেয়েছে। মৃণাল সেন থেকে আরম্ভ করে বড় বড় চলচ্চিত্র পরিচালকরা তাঁর প্রসংশা করেছেন।”

ববিতা বলেন, “আমজাদ ভাই গ্রামকে ভীষণ ভালবাসতেন। এ কারণে তাঁর প্রত্যেক ছবিতে গ্রামের বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় উপস্থিত থাকত। এটি একটি অনবদ্য দিক বলতে হবে। যা আজকাল দেখাই যায় না।”

‘নয়নমনি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘বড়বাড়ির মেয়ে’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়,’- এসব ছবির নাম উল্লেখ করে ববিতা বলেন, “আমাদের দেশে সাধারণত আর্টফিল্মগুলো পুরস্কৃত হয় অথচ সিনেমা হলে গিয়ে মুখ থুপড়ে পড়ে যায়। ব্যবসা সফল হয় না। কিন্তু আমজাদ হোসেনের ছবিগুলো ব্যবসায়িক সফলতা অর্জনের পাশাপাশি জাতীয় পুরস্কার, বিদেশি ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রসংশিত হয়েছে। এটা মিরাকল ব্যাপার ছিল।”

জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই নায়িকা বলেন, “আমজাদ ভাইয়ের লেখা গান, স্ক্রিপ্ট, নির্দেশনা সব ছিল অসাধারণ। এককথায় তিনি অসাধারণ গুণী মানুষ ছিলেন। তাঁর অকাল প্রয়াণে আমি মর্মাহত।”

প্রয়াত আমজাদ হোসেনের লেখা গানের প্রসংশা করে সুরকার আলাউদ্দিন আলী বেনারকে বলেন, আমজাদ ভাই কতটা গুণী মানুষ ছিলেন তা দু’চার কথায় বোঝানো সম্ভব নয়। চলচ্চিত্র বানানোর পাশাপাশি তিনি গান লিখতেন। তাঁর লেখা প্রত্যেকটি গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সেসব গান আর কেউ লিখবে না।”

এসময় আমজাদ হোসেনের লেখা অসংখ্য গানের কথা উল্লেখ করেন তিনি।

আমজাদ হোসেনের মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শোক প্রকাশ করছেন চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীত সংশ্লিষ্টরা।

আমজাদ হোসেনের উল্লেখযোগ্য কাজ

১৯৪২ সালের ১৪ অগাস্ট জামালপুরে জন্ম নেন আমজাদ হোসেন।

১৯৬১ সালে ‘হারানো দিন’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে রুপালি পর্দায় তাঁর যাত্রা শুরু। তবে পরে চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনায় মন দেন তিনি। চিত্র পরিচালনার বাইরে লেখক, গীতিকার, অভিনেতা হিসেবেও পরিচিত আমজাদ হোসেন। সাড়া জাগানো বাংলা সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’র চিত্রনাট্য লেখায় জহির রায়হানের সঙ্গে আমজাদ হোসেনও সম্পৃক্ত ছিলেন।

তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘খেলা’ মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালে। তাঁর পরিচালিত জনপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাল্যবন্ধু’, ‘পিতাপুত্র’, ‘এই নিয়ে পৃথিবী’, ‘বাংলার মুখ’, ‘নয়নমণি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘সখিনার যুদ্ধ’, ‘ভাত দে’, ‘হীরামতি’, ‘প্রাণের মানুষ’, ‘সুন্দরী বধূ’, ‘কাল সকালে’, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’, ‘গোলাপী এখন বিলেতে’ প্রভৃতি।

টিভি নাটক লেখা ও নির্মাণ করেও প্রসংশা পান তিনি।

আমজাদ হোসেন গান লেখায়, চিত্রনাট্যে ও পরিচালনায় চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এরমধ্যে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমার জন্য ১৯৭৮ সালে ও ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ১৯৮৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। এ ছাড়া আরও অসংখ্যবার জাতীয় স্বীকৃতি, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেন তিনি।

গুণী এই ব্যক্তিত্বকে ১৯৯৩ সালে একুশে পদকে ভূষিত করে সরকার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।