রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আবারও অনিশ্চিত; তালিকাভুক্ত অনেকেই যেতে রাজি নয়
2019.08.20
টেকনাফ ও ঢাকা

কক্সবাজারে অবস্থানকারী ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মধ্যে মিয়ানমারের ছাড়পত্র পাওয়া তিন হাজার ৫৪০ জনের অনেকেই রাখাইন রাজ্যে ফিরতে রাজি হননি।
তালিকাভুক্তদের মধ্যে মাত্র ২১ জন মঙ্গলবার জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) এবং বাংলাদেশের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) প্রতিনিধিদের কাছে তাদের মতামত জানিয়েছেন।
এ তথ্য নিশ্চিত করে আরআরআরসির প্রতিনিধি এবং জাদিমুরা ও শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ মোহাম্মদ খালেদ হোসেন বেনারকে বলেন, “প্রত্যাবাসনের তালিকাভুক্ত এই রোহিঙ্গারা তাদের মতামত জানিয়েছেন।”
“তাদের মতামত একটি ফরমে লিপিবদ্ধ করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। তবে প্রত্যাবাসনের তালিকায় নাম থাকা সব রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকারের জন্য আনা যায়নি,” যোগ করেন সরকারি এই কর্মকর্তা।
টেকনাফের শালবাগান শরণার্থীশিবিরে তৈরি করা বিশেষ আটটি ঘরে ইউএনএইচসিআর এবং আরআরআরসির কর্মকর্তারা প্রত্যাবাসনে তালিকাভুক্তদের সাক্ষাৎকার নেন।
এ সময় রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা এবং গণহত্যাকারীদের বিচার চেয়েছেন। একই সঙ্গে নিজেদের ফেলে আসা সম্পত্তির অধিকার এবং ক্ষতিপূরণ চায় রাখাইন রাজ্য ত্যাগে বাধ্য হওয়া এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ বেনারকে বলেন, “আমরাও চাই প্রত্যাবাসন শুরু হোক। স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন হলে সহযোগিতা করতেও রাজি আছি। কিন্তু এভাবে হঠাৎ করে কীভাবে প্রত্যাবাসন শুরু হয়?”
তাঁর দাবি, গত মাসে রোহিঙ্গা শিবির সফরকারী মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিব মিন্ট থোয়ের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিরা প্রত্যাবাসনের আগে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে ফের সংলাপে বসার কথা বলেছিলেন।
“আমাদের (রোহিঙ্গা নেতাদের) সঙ্গে আলোচনা না করেই প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলে রোহিঙ্গারা যেতে চাইবে না বলেই ধারনা। তাছাড়া এই মুহূর্তে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি,” বলেন মুহিব।
রাখাইনের পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সেদেশে যেসব রোহিঙ্গারা রয়ে গেছে তাঁরাও বন্দী জীবনযাপন করছেন।”
এর আগে গত শুক্রবার মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে দেশটির সরকারি মুখপাত্র জ থে এক প্রেস কনফারেন্সে জানান, ২২ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন শুরু হচ্ছে এবং তারা কক্সবাজার থেকে তিন হাজার ৫৪০ জনতে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছেন।
এ ব্যাপারে আরআরআরসি জানায়, দুই দফায় মিয়ানমারকে ২২ হাজার ৪৩২ এবং ২৫ হাজার সাতজন রোহিঙ্গার দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য থেকে ওই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ছাড়পত্র দিয়েছে। যারা এই ছাড়পত্র পেয়েছে তাদের ঘরে ঘরে খবর পৌঁছানোর পর মঙ্গলবার সকাল থেকে ইউএনএইচসিআরকে সাথে নিয়ে মতামত নেওয়া শুরু করা হয়।
ইউএনএইচসিআর এবং আরআরআরসির মোট ১০টি দল ঘরে ঘরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের মতামত জানাতে আসতে উৎসাহিত করে। এ সময় কিছু রোহিঙ্গা তাদের বাঁধা দেয়। পরে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনেন।
টেকনাফ মডেল থানার পরিদর্শক রাকিবুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “কিছু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা চেষ্টা করছিল, পুলিশ সতর্ক অবস্থানে থাকায় ব্যর্থ হয়। পরে দুপুর আড়াইটার পর রোহিঙ্গারা সাক্ষাৎকার দিতে আসতে শুরু করেন।”
রোহিঙ্গাদের ফিরতে অনাগ্রহ
প্রত্যাবাসনের ছাড়পত্র পাওয়া রোহিঙ্গা আবু ছিদ্দিকের (৩০) বাড়ি মংডু গজবিল এলাকায়। সাক্ষাৎকার দিয়ে বের হয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে মিয়ানমারে যাব কিনা? জবাবে ‘না’ বলেছি। কেন যাবেন না জানতে চাইলে ফেলে আসা সহায়-সম্বল, নাগরিকত্ব ও গণহত্যার বিচার পেলে যাওয়ার কথা বলেছি।”
২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাঁর এলাকাতেই প্রথম হামলা চালিয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যেখানে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি, সেখানে কি আবার মরতে যাব? এটি কখনোই হতে পারে। সেখানে এখনো আমাদের যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি।”
আরেক সাক্ষাৎকারদাতা আবু তাহের ওরফে সোনা মিয়া (৪০) বেনারকে বলেন, “ইউএনএইচসিআর আর ক্যাম্প ইনচার্জের প্রতিনিধিরা ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে বলেছি, আমি এখন মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি নেই। কেননা সেদেশের সরকারই মানুষ হত্যা করে।”
“জীবনের নিরাপত্তা এবং আমার ভিটে মাটি ফিরে না পেলে কেন যাব?” প্রশ্ন রাখেন তিনি।
প্রত্যাবাসনের তালিকায় নাম থাকা সাবেকুন নাহার (২৫) বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারে আমরা ফিরতে চাই না। সেদেশে আমার ভাইয়ের গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর লাশ দাফন করারও সুযোগ পাইনি।”
বাংলাদেশে মারা গেলে অনন্ত লাশ দাফনের সুযোগ পাব, উল্লেখ করে এই রোহিঙ্গা নারীও বলেন, “সেদেশে যারা এখনো রয়েছে, তাদের জিম্মি করে রেখেছে। এ অবস্থায় আমরা কি করে যাবো?”
মিয়ানমারের তালিকায় থাকা তিন হাজার ৫৪০ জনের মধ্যে তিন হাজার ৩১০ জনই জাদিমুরা ও শালবাগানের জানিয়ে ওই দুই শরণার্থী ক্যাম্পের ইনচার্জ খালেদ বলেন, “বুধবারও তাদের মতামত নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।”
সাক্ষাৎকার রোহিঙ্গাদের দেওয়ার বক্তব্যের ব্যাপারে কিছু জানাতে চাননি তিনি।
ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র জোসেফ সূর্য ত্রিপুরাও বেনারকে বলেন, “এ বিষয়ে আজ কিছুই জানানো হবে না।”
উখিয়ায় মিয়ানমারের তদন্ত দল
এদিকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহে মিয়ানমারে গঠিত ‘ইন্ডিপেনডেন্ট কমিশন অফ ইনকোয়ারির’ অগ্রবর্তী একটি দল মঙ্গলবার কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালীর শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেছে । তারা কুতুপালং এবং বালুখালীর বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শনের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেন।
এর আগে সোমবার সকালে কক্সবাজার পৌঁছে দুপুরে আরআরআরসি এবং সন্ধ্যায় ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন দলটির সদস্যরা।
বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে প্রত্যাবাসন
২২ আগস্টের মতো গত বছরের নভেম্বরেও প্রত্যাবাসন শুরুর একটা একটা সম্ভাবনা ছিল উল্লেখ করে বিশ্লেষকেরা বলছেন, তখনো শুরু হয়নি, এবারও যে হবে না তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় ।
মিয়ানমার কূটনৈতিকভাবে খুবই চতুর চাল চেলেছে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনে বেনারকে বলেন, “চীন-ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের কাছে কিছুটা নতি স্বীকার করে তারা হয়তো বলছে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে, কিন্তু রাখাইনে প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেনি ।”
তাঁর দাবি, “মিয়ানমার প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ার দায়ভার বাংলাদেশ বা রোহিঙ্গাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে । এরপর তারা বলবে আমরা ফেরত নিতে চাচ্ছি, কিন্তু বাংলাদেশ পাঠাচ্ছে না কিংবা রোহিঙ্গারা আসতে চাচ্ছে না।”
“রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেটা নিঃসন্দেহে জটিল । শরণার্থী ক্যাম্পগুলোয় অনেক দেশের অনেক সংস্থা কাজ করছে। তারা রোহিঙ্গাদের মতামতকে প্রভাবিত করছে কিনা, তা নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে,” যোগ করেন তিনি ।