করোনাকালে ঝুঁকিতে গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারীরা
2020.07.02
কক্সবাজার ও ঢাকা

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে নিয়মিত চিকিৎসা ব্যহত হওয়ায় ঝুঁকির মুখে পড়েছেন কক্সবাজারের কয়েক হাজার গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারী।
গর্ভবতীদের অভিযোগ, চিকিৎসাকেন্দ্রে তাঁরা সেবা পাচ্ছেন না, অন্য দিকে স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন মহামারির কারণে স্বাস্থ্যকেন্দ্র আসা কমিয়ে দিয়েছেন রোগীরা।
কক্সবাজারের তিনটি শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের পরিবর্তে ওষুধের দোকান কিংবা কবিরাজের শরণাপন্ন হচ্ছেন অনেক গর্ভবতী।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) পরিচালিত লেদা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়মিত পরীক্ষার জন্য চার বার গিয়েও সেবা না পেয়ে ফিরে আসার অভিযোগ করছেন গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারী নুর নাহার (২০)।
তিনি বেনারকে বলেন, “করোনাকালে পেটে বাচ্চা নিয়ে খুবই ভয়ে আছি। তার ওপর গত তিনমাসে চেকআপের জন্য হাসপাতালে গেলেও পরপর চারবার ফেরত আসতে হয়।”
“এখন আবার আমার দুই পা ফুলে গেছে। মাঝে মধ্যে পুরো শরীর প্রচণ্ড ব্যথা করে, তবুও ডাক্তার দেখাতে পারছি না,” বলেন নুর নাহার।
“প্রথম সন্তান হবে আমার। প্রায়ই শরীর খারাপ থাকে। কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে ভয় পাই। কারণ, করোনা আক্রান্তরাও সেখানে চিকিৎসা নিতে আসে,” বেনারকে বলেন রোহিঙ্গা নারী ফাতেমা খাতুন (২০)।
তিনি বলেন, “কোনো স্বাস্থ্য কর্মী ঘরে এসে খোঁজ খবর নেয়নি। আবার মোবাইলেও ডাক্তার দেখানোর কোনো ব্যবস্থা নেই।”
উল্লেখ্য, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারের ৩৪টি শিবিরে বসবাস করছেন।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এর করা সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী চলতি বছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৪টি ক্যাম্পে ৩১ হাজার ২’শ গর্ভবতী নারী রয়েছেন।
ফেব্রুয়ারির পরে আর কোনো জরিপ না হলেও করোনাকালে গর্ভবতীর সংখ্যা বেড়েছে বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে টেকনাফের লেদা নতুন শিবিরে পাঁচ হাজারের পরিবারে শতাধিক গর্ভবতী নারী রয়েছেন বলে বেনারকে জানান রোহিঙ্গা নেতা মোস্তফা কামাল।
তিনি বলেন, “এই করোনাকালে হাসপাতালে গিয়ে দিনভর অপেক্ষার পরেও অনেকে চিকিৎসা পাচ্ছেন না। তখন বাধ্য হয়ে ওষুধের দোকানদারের চিকিৎসা নিতে হয়।”
“এই সময়ে সন্তান প্রসব করা ও নবজাতক লালন পালন করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠেছে,” বলেন তিনি।
এদিকে গর্ভবতীদের সব সময় চিকিৎসকের পর্রামর্শে থাকতে হবে জানিয়ে প্রসূতি বিশেষজ্ঞ মো. হায়দার আলী বেনারকে বলেন, “কমপক্ষে চারবার গর্ভবতী নারীদের চেকআপ করা খুবই জরুরি।”
করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা সম্ভব না হলে ফোনে অথবা অনলাইনে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করতে হবে বলে জানান তিনি।
“না হলে রোগীর রক্তশূন্যতা বা গর্ভে বাচ্চার বৃদ্ধি না হওয়াসহ বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে,” বলেন ডা. হায়দার আলী।
রোগী আসা কমেছে
করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় বর্তমানে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা কমেছে বলে বেনারকে জানান টেকনাফ লেদা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
“করোনাকালেও গর্ভবতী নারীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়া হয়,” দাবি করে তিনি বলেন, “এমনকি তাঁদের টিকা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা নিতে উদ্বুদ্ধ করছেন স্বাস্থ্য কর্মীরা।”
“কিন্তু ক্যাম্পের লোকজন ঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে আসেন না। অনেকে ওষুধের দোকানদার, কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। যারা হাসপাতালে আসেন, তাঁরা শেষ অবস্থায় আসেন,” বলেন ডা. জাহাঙ্গীর।
করোনাকালেও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন গর্ভবতী নারীসহ বিভিন্ন ধরনের শতাধিক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে বেনারকে জানান আইওএম স্বাস্থ্য বিভাগের টেকনাফের কোঅর্ডিনেটর নাঈ মা প্রু।
এই মহামারির মধ্যেও গর্ভবতী কোনো নারী যাতে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হন সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “পাশাপাশি তাঁদেরকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রমুখী করতে স্বাস্থ্যকর্মীরা মাঠে কাজ করছেন।”
এদিকে করোনা মহামারির কারণে সাধারণ স্বাস্থ্য সেবায় কিছুটা ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে বলে স্বীকার করেন কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।
তবে “শুধু রোহিঙ্গা নয়, যেকোনো গর্ভবতী নারী যাতে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত না হয়, সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে,” বলেন তিনি।
অবহেলায় নবজাতকের মৃত্যুর অভিযোগ
আইওএম পরিচালিত চিকিৎসা কেন্দ্রের অবহেলায় প্রসবকালে সন্তানের মৃত্যুর অভিযোগ তুলেছেন লেদা শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা নারী ছেতারা বেগম (৩০) ও তাঁর স্বামী।
ছেতারার স্বামী নুরুল ইসলাম বেনারকে জানান, গত ৮ জুন বিকেলে প্রসবের জন্য ছেতেরাকে আইওএম পরিচালিত টেকনাফ লেদা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। ৯ জুন ভোরে গর্ভাবস্থা থেকে বাচ্চা মাথা পর্যন্ত বের হয়ে আটকে যায়।
“এক সময়ে সেখানকার চিকিৎসক ও নার্সরা হাল ছেড়ে দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ভুল হয়ে গেছে এই রোগীকে এখানে রাখা ঠিক হয়নি,” বলেন নুরুল ইসলাম।
ওই অবস্থায় ছেতেরাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজারে নেওয়া হলে সেখানে মৃত সন্তান প্রসব করেন তিনি।
নুরুল জানান, গর্ভকালীন পুরো সময়ে ছেতেরা মাত্র দুবার ডাক্তার দেখাতে পেরেছিলেন, এর মধ্যে একবার করোনাকালে।
“হয়তো নিয়মিত চেকাপ করাতে পারলে আমার সন্তানটি বেঁচে যেত,” বলেন নুরুল।
নুরুলের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আইওএম, কক্সবাজারের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান সমীর কুমার হাওলাদার বেনারকে বলেন, “আমাদের স্বাস্থ্য সেবা খুবই স্বচ্ছ। সেখানে চিকিৎসা অবেহলা হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের।”
তবে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পাওয়া গেলে “তদন্ত করে ব্যবস্থ নেওয়া হবে,” জানান তিনি।
চার দিন রোহিঙ্গা আক্রান্ত নেই, দেড় লাখ ছাড়িয়েছে বাংলাদেশ
গত চার দিন ধরে কোনো রোহিঙ্গা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি বলে বেনারকে জানিয়েছেন কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের প্রধান স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ডা. আবু তোহা এম আর এইচ ভূঁইয়া।
ডা. তোহা জানান, এখন পর্যন্ত মোট ৫০ জন রোহিঙ্গা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, এর মধ্যে মারা গেছেন পাচঁজন।
এদিকে এক দিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়ে গেছে বৃহস্পতিবার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে নতুন করে ৪ হাজার ১৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। একই সময়ে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩৮ জন।
ফলে বর্তমানে দেশে মোট করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ৫৩ হাজার ২৭৭, আর এই রোগে মৃতের সংখ্যা এক হাজার ৯২৬।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট এক কোটি সাত লাখ ৭৬ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন পাঁচ লাখ ১৭ হাজারের বেশি।