একই সাথে করোনা ও ডেঙ্গুর সংক্রমণ: বাড়িয়ে তুলছে বিপদের আশঙ্কা

আহম্মদ ফয়েজ
2021.08.09
ঢাকা
একই সাথে করোনা ও ডেঙ্গুর সংক্রমণ: বাড়িয়ে তুলছে বিপদের আশঙ্কা ঢাকা শিশু হাসপাতালে মশারির ভেতর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত কয়েকজন শিশু। ৯ আগস্ট ২০২১।
[আহম্মদ ফয়েজ/বেনারনিউজ]

কোনো কোনো রোগীর একই সাথে করোনা ও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের। গত কয়েক সপ্তাহে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে করোনা ও ডেঙ্গুর যৌথ সংক্রমণ হওয়া বেশ কিছু রোগীর খোঁজ পাওয়া গেছে। 

বেনার প্রতিনিধি রাজধানীর তিনটি সরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করে অন্তত ১৯ জন যৌথ সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীর খোঁজ পেয়েছেন। 

সাধারণত করোনাভাইরাসে প্রাপ্ত বয়স্কদের বেশি ঝুঁকি থাকলেও ডেঙ্গু জ্বর শিশুদের জন্য বিপদজনক বলে মনে করেন চিকিৎসকেরা। রাজধানীর শিশু হাসপাতালে এ বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হওয়া শিশুদের মধ্যে চারজন মারা গেছেন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। 

এই শিশুদের একজন করোনাভাইরাস ও ডেঙ্গু জ্বরের যৌথ সংক্রমণে আক্রান্ত ছিলেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কিংকর ঘোষ।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, করোনাভাইরাস ও ডেঙ্গুর যৌথ সংক্রমণে রোগীদের জীবন আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। 

রাজধানীর করোনা ডেডিকেটেড মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অসীম কুমার নাথ বেনারকে জানান, হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা করোনা রোগীদের মধ্যে কমপক্ষে আটজনের শরীরে ডেঙ্গুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

“যৌথ সংক্রমণের শিকার রোগীদের চিকিৎসা অন্যান্য রোগীদের মতো নয়। এখানে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে হচ্ছে, যার ফলে চিকিৎসা জটিলতার পাশাপাশি, চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে রোগীদের স্বজনদেরও,” বেনারকে বলেন অসীম কুমার। 

ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বেনারকে বলেন, “আমাদের হাসপাতালে অন্তত ১০জন রোগীকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা করোনা ও ডেঙ্গুর যৌথ সংক্রমণের শিকার।” 

তিনি বলেন, যৌথ সংক্রমণের শিকার রোগীদের চিকিৎসা বেশ জটিল। কারণ রোগীর শারীরিক অবস্থার সার্বক্ষণিক অবস্থান বুঝে তার ভিত্তিতে ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। 

“এমন কিছু ওষুধ আছে যা করোনায় আক্রান্ত রোগীকে দেয়া যায় কিন্তু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীকে তা দিলে বিপদ হতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে আমাদের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হচ্ছে এবং প্রতিটি নতুন রোগীর ক্ষেত্রেই করোনা ও ডেঙ্গুর টেস্ট করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নির্ধারণ করতে হচ্ছে,” যোগ করেন এম নাসির উদ্দিন। 

জ্বরকে অবহেলা নয়

করোনাভাইরাস ও ডেঙ্গুর প্রকোপের সময়ে শিশুদের মধ্যে জ্বরের লক্ষণ দেখা দিলেই কোনো প্রকার বিলম্ব না করেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে বলে বেনারকে জানান ঢাকা শিশু হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ কিংকর ঘোষ।

“এই সময়ে জ্বর নিয়ে ছোট অবহেলা বড়ো দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের হাসপাতালে যৌথ সংক্রামণে ছয় বছর বয়সী যে শিশুটি মারা গেছে তাকে হাসপাতালে আনতে স্বজনরা দেরি করে ফেলেছেন। এ বিষয়ে অভিভাবকদের সতর্ক থাকার বিকল্প নেই।” 

শিশু হাসপাতালে একজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে, যার করোনাভাইরাসেরও উপসর্গ রয়েছে। তার মা সৈয়দা নাতাশা জাহান বেনারকে বলেন, সন্তানের সেবা করার জন্য হাসপাতালে আছেন তিনি, কিন্তু হাসপাতালে থেকে করোনায় আক্রান্ত হবার ভয় তাঁকে তাড়া করছে। 

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর বেনারকে জানান, যৌথ সংক্রমণের ঘটনা তাঁদের নজরে এসেছে। তবে দেশে গত বছর কতজন ব্যক্তি এমন সংক্রমণের শিকার হয়েছেন এবং চলতি বছর এ ধরনের রোগীর সংখ্যা কত সেই হিসাব নেই।

তিনি বলেন, “এটা সত্য করোনা ও ডেঙ্গুর যৌথ সংক্রমণ মোকাবেলা করা চ্যালেঞ্জিং। কোনো কোনো ক্ষেত্রে করোনা ও ডেঙ্গুর যৌথ সংক্রমণ রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।” 

আইইডিসিআরের এই কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান মৌসুমে কোনো প্রকার জ্বরকেই অবহেলা করার সুযোগ নেই। জ্বর হলেই করোনা ও ডেঙ্গুর টেস্ট করতে হবে এবং অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শে চলতে হবে।

যৌথ সংক্রমণে ঝুঁকি বেশি

বাংলাদেশে ছাড়াও আরো নয়টি দেশে গত বছর করোনা ও ডেঙ্গুর যৌথ সংক্রমণের খোঁজ পান গবেষকরা।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকাশনায় প্রকাশিত ১৩টি নিবন্ধ ও চারটি সংবাদের বিশ্লেষণ করে অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষক নিশ্চিত হন যে, বাংলাদেশসহ দশটি দেশে যৌথ সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। চলতি মাসের ২ আগস্ট চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণা সাইট “বায়োমেড সেন্টারে” প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যৌথ সংক্রমণের সাধারণ উপসর্গগুলো ছিল জ্বর, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা এবং কাশি। 

“যৌথ সংক্রমণের মারাত্মক ফলাফলগুলির মধ্যে রয়েছে সেপটিক শক, তীব্র শ্বাসকষ্ট হওয়া এবং শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া, যা রোগীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়,” বলা হয়েছে ওই গবেষণা প্রতিবেদনে। 

এই গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুল হোসেন বেনারকে বলেন, “সাধারণত উচ্চ তাপমাত্রা মানুষের অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ বিকল করে দেয়ার ক্ষেত্রে বড়ো ধরনের ভূমিকা রাখে। এখন পর্যন্ত যতগুলো গবেষণা দেখা গেছে তাতে এই বিষয়টা পরিষ্কার যে, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের করোনা পরবর্তীতে নানা শারীরিক সমস্যা হয়। এর সঙ্গে ডেঙ্গু যুক্ত হলে যে সংক্রমিত ব্যক্তি মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারেন, তা সহজে বলা যায়।” 

জীববিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “ডেঙ্গু এবং করোনা দুটিই বিপজ্জনক। একই সময়ে এটি মোকাবেলা করা কঠিন। একই ব্যক্তি একসঙ্গে এই দুই রোগে আক্রান্ত হলে এটা সত্যিই খুব কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করে।” 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সোমবার সকাল আটটা পর্যন্ত দেশে ৪ হাজার ৭৫৩ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন, যাদের অধিকাংশই ঢাকায়। 

ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১৪টি মৃত্যুর তথ্য আইইডিসিআর পাঠানো হয়েছে। তবে আইইডিসিআর এখনও কোনো মৃত্যুর পর্যালোচনা শেষ করেনি বলে অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।