বঙ্গোপসাগর থেকে ঘূর্ণিঝড়ে নিমজ্জিত ৫৬ জেলে উদ্ধার, এখনো নিখোঁজ ৯০
2017.06.01
কক্সবাজার

ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতে বঙ্গোপসাগরে নিমজ্জিত ৫৬জন জেলেকে উদ্ধার করা হলেও আরো অন্তত ৯০জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী পাঠিয়েছে ভারত। তবে সরকারি-বেসরকারি কোনো ধরনের সহায়তা ছাড়া দুর্ভোগ আর দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছেন ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত কক্সবাজারের হাজার হাজার রোহিঙ্গা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক হিসেবে ঘূর্ণিঝড় মোরায় উপকূল এলাকায় ২ লাখ ৮৬ হাজার ২৪৫ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতে ৬ জন নিহত ও ৬১ জন আহত হয়েছেন। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৯ হাজার ৫২৮ টি।
এছাড়া সমুদ্র থেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধারের পর একজন জেলে নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
৫৬ জন জেলে উদ্ধার নিখোঁজ ৯০
এখন পর্যন্ত সমুদ্র থেকে ৫৬ জন জেলেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ভারতের নৌবাহিনী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশিদের জন্য ত্রাণ নিয়ে চট্টগ্রাম আসার পথে ডুবে যাওয়া দুটি নৌকার ৩৩ জন জেলেকে উদ্ধার করে। এদের মধ্যে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা একজন মারা যান।
বঙ্গোপসাগরে উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে টানা ২৫ ঘণ্টার বেশি লড়াই করে বেঁচে গেছেন মহেশখালীর বাসিন্দা ওসমান গণি। বুধবার সকালে তাঁর মতো ৩৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী।
ওসমান গণি সাংবাদিকদের বলেন, “বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। উদ্ধারের পর মনে হচ্ছে, নতুন জীবন পেয়েছি।”
এদিকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ নৌবাহিনী ২৩ জন জেলেকে উদ্ধার করেছে বলে জানা গেছে।
“…২৩ জন জেলেকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা হয়েছে,” বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানান বাংলাদেশ নৌবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা।
তবে এখন পর্যন্ত কতজন জেলে নিখোঁজ রয়েছেন সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও কক্সবাজার মাছ ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি মুশতাক আহমেদ বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, “আমাদের হিসেবে এখনো ৯০ জনের মতো জেলে নিখোঁজ রয়েছেন।”
নিখোঁজ জেলেদের উদ্ধারে তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের দেখার কেউ নেই
এখ পর্যন্ত কোনো ধরনের ত্রাণ সহায়তা না থাকায় ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে দুর্ভোগ আর দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছেন কক্সবাজারের অনিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরের হাজার হাজার রোহিঙ্গা। গত মঙ্গলবারের ঘূর্ণিঝড়ে জেলার উখিয়া ও টেকনাফ এলাকার অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর কয়েক হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।
“এখানকার রোহিঙ্গারা না খেয়ে জীবন যাপন করছে। ঘুর্ণিঝড় মোরার আঘাতে এ বস্তির প্রায় প্রায় দুই হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে,” বেনারকে বলেন টেকনাফ লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সভাপতি মো. দুদু মিয়া।
তিনি জানান, “টিন ও গাছ পড়ে ৪০ জনের মত আহত হয়েছেন। এই বস্তির প্রায় ২০ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।”
“ক্যাম্পে তিন হাজার ৫২ টি ঘর আছে। এর মধ্যে আড়াই হাজার ঘর ভেঙে গেছে,” বেনারকে জানান উখিয়া বালুখালী নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সভাপতি মো. হারুন।
ক্যাম্পে গত দুদিন ধরে খাদ্য ও খাবার পানির সংকট চলছে বলেও জানান তিনি।
সরেজমিন গিয়ে অনিবন্ধিত ক্যাম্পগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেখা গেলেও ঢাকায় দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারিভাবে কেবল নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদেরই সহায়তা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বুধবার বেনারকে জানান, “দুর্যোগ মন্ত্রণালয় কেবল মাত্র নিবন্ধিত দুটি রোহিঙ্গা (কুতুপালং ও নয়াপাড়া) ক্যাম্প নিয়ে কাজ করে। ওই ক্যাম্পে ৩৪ হাজারের মতো রোহিঙ্গা রয়েছে। ঝড়ে তারা ক্ষতিগ্রস্ত নয়।”
“অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের কোনো সমস্যা আছে কিনা, সেটা আমাদের জানা নেই,” এক প্রশ্নের জবাবে জানান ওই কর্মকর্তা।
তবে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবদুর রহমান বেনারকে বলেন, “সংশ্লিষ্ট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের তালিকা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওই তালিকা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হবে এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এই মুহূর্তে অনিবন্ধিত ক্যাম্পগুলোতে কোনো ধরনের খাদ্য সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে না বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানান জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর একজন কর্মকর্তা।
তিনি জানান, ইউএনএইচসিআর সরাসরি অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিতে পারে না। আইওএম, ডব্লিউএফপি এবং অন্য কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সহায়তা দেওয়া হয়।
তবে রোববার থেকে কয়েকটি সংস্থা কিছু খাদ্য বিতরণ করবে বলে আশা প্রকাশ করেন ইউএনএইচসিআর এর ওই কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে প্রায় ৭৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। জাতিসংঘ ওই ঘটনার তদন্তে কমিটি করেছে। নানামুখি আন্তর্জাতিক চাপ ও সমালোচনার মুখেও মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের ফেরত নেওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
সরকারের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ৷ তবে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ৩৪ হাজার৷
ত্রাণ পাঠিয়েছে ভারত
বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে ভারতের ত্রাণবাহী জাহাজ ‘আইএনএস সুমিত্রা’ থেকে ঘূর্ণিজড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণসামগ্রী বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা আনুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরীর কাছে হস্তান্তর করেন।
ভারতের পাঠানো ত্রাণ সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে প্যাকেটজাত খাবার, ওষুধ, কম্বল, প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম, তাঁবু ও কাপড়চোপড়।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে ভারতের ত্রাণসামগ্রী দুর্গত এলাকায় পাঠানো হবে। তবে সম্ভবত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকা বিশেষ করে সন্দ্বীপ, আনোয়ারা, বাঁশখালী, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিনে এসব ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হবে।