ঘূর্ণিঝড় আম্পানে পশ্চিমবঙ্গে নিহত ৭২, বাংলাদেশে ১৬ জন

পরিতোষ পাল ও শরীফ খিয়াম
2020.05.21
কলকাতা ও ঢাকা
200521_Amphan-Bangla_1000.jpg সাতক্ষীরায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ভেঙে পড়া গাছ রাস্তা থেকে সরাচ্ছেন কর্মীরা। ২১ মে ২০২০।
[বেনারনিউজ]

ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ৮৮জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৭২ জন পশ্চিমবঙ্গের, বাংলাদেশের ১৬ জন।

বাংলাদেশে প্রাণহানি কম হলেও ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় প্রত্যক্ষ করেছে ভারতের বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। ঝড়ের তাণ্ডবকে ইতোমধ্যে ‘করোনার চেয়ে বড় বিপর্যয়’ বলে উল্লেখ করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

“এমন বিপর্যয় এর আগে কখনও দেখিনি। ঝড়ের তাণ্ডবে রাজ্যে ৭২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কলকাতা জেলায় মারা গেছেন ১৫ জন,” বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন মমতা।

নিহতদের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে দুই লক্ষ রুপি করে সাহায্য দেওয়ার কথাও জানিয়েছে রাজ্য সরকার।

কলকাতার বাইরের ছয় জেলায় মৃত্যু হয়েছে ৫৭ জনের। উত্তর ২৪ পরগণায় ১৭ ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায় ১৮ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া হাওড়ায় সাত, পূর্ব মেদিনীপুরে ছয়, হুগলিতে তিন ও নদীয়ায় ছয় জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

এদিকে এই ঝড়ে বাংলাদেশে অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

যশোরে মোট ছয়জন মারা গেছেন বলে বৃহস্পতিবার রাতে বেনারকে জানান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ।

এর বাইরে পিরোজপুরে তিনজন, পটুয়াখালী ও ভোলায় দুইজন করে এবং ঝিনাইদহ, চট্টগ্রাম ও সাতক্ষীরায় একজন করে মারা গেছেন বলে বৃহস্পতিবার জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

বুধবার সন্ধ্যায় সুন্দরবন লাগোয়া সাতক্ষীরা অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে আম্পান। বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রমের সময় এর সর্বোচ্চ গতি ওঠে ঘণ্টায় প্রায় দেড়শ কিলোমিটার। তবে মূল ভূখণ্ডে উঠে আসার পর বাতাসের গতি ১২০ কিলোমিটারে নেমে আসে।

বুধবার দুপুরের পর থেকে বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণাসহ রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় আম্পান। সেখানকার আবহাওয়া দপ্তর জানায়, ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় গতিবেগ ছিল এই ঝড়ের। কোথাও ১৮৫ কিলোমিটার গতি উঠেছিল। কলকাতায় সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ১৩৩ কিলোমিটার।

পশ্চিমবঙ্গে অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে রাস্তায় পড়ে থাকা বিদ্যুতের তারে বিদ্যুৎস্পৃশ্য হয়ে। এ ছাড়া গাছ এবং দেয়াল ভেঙ্গে ও টিনের আঘাতে বাকিদের মৃত্যু হয়েছে। অনেক এলাকার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় পরবর্তী সময়ে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও রাজ্য সরকার জানিয়েছে।

সাতক্ষীরায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে জলোচ্ছাসে ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করছেন গ্রামবাসীরা। ২১ মে ২০২০।
সাতক্ষীরায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে জলোচ্ছাসে ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করছেন গ্রামবাসীরা। ২১ মে ২০২০।
[বেনারনিউজ]

ক্ষতি নির্ধারণে সময় লাগবে

বৃহস্পতিবার টাস্ক ফোর্সের বৈঠকে পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেন, “রাজ্যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ জানতে কয়েকদিন সময় লাগবে। বহু জায়গায় যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভেঙ্গে গেছে অজস্র বাড়ি ও বাঁধ।”

দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগণা এবং কলকাতা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়ার কথা উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী জানান, তিনি সাতদিনের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ হিসাব চেয়েছেন।

ঢাকায় বাংলাদেশ সচিবালয় থেকে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান জানান, মোট ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানতে অন্তত সাত দিন সময় লাগবে। প্রাথমিকভাবে ২৬টি জেলায় ১১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানতে পেরেছে সরকার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের বৃহস্পতিবার থেকেই ঘর নির্মাণ, অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা দিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) প্রেস উইংয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।

পশ্চিমবঙ্গকে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এক টুইট বার্তায় বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে আম্পান যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, সেই দৃশ্য দেখেছি। এই সংকটময় মুহূর্তে গোটা দেশ পশ্চিমবঙ্গের পাশে আছে। রাজ্যের মানুষের শুভ কামনা করছি।”

ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে শুক্রবারই রাজ্যে আসার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর সূত্রে টুইট করে জানানো হয়েছে, শুক্রবার আকাশপথে রাজ্যের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করবেন মোদী।

 

 

থমকে গেছে কলকাতা শহর

ঘূর্ণিঝড় চলে যাবার ২৪ ঘন্টা পরও কলকাতার সর্বত্র ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র। বহু রাস্তা গাছ পড়ে অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অধিকাংশ এলাকার। প্রবল বর্ষণের কারণে শহরের অনেক জায়গাই জলে ডুবে রয়েছে।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর বৃহস্পতিবারও জলমগ্ন ছিল। রানওয়েতে জল জমে থাকার কারণে বিমান চলাচল বন্ধ রাখা হয়।

দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা নবনীতা ঘোষ বেনারকে বলেন, “কলকাতার এমন ভয়াবহ চেহারা আগে কখনো দেখিনি। নজিরবিহীন বৃষ্টিতে কলকাতা জলমগ্ন হয়ে গেছে। তীব্র গতিতে আসা ঝড়ে বাড়িঘর তছনছ হয়েছে।

কলকাতার বিদায়ী মেয়র ও রাজ্যের পুর ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম সাংবাদিকদের বলেন, “কলকাতায় প্রায় ৫ হাজার গাছ ভেঙ্গেছে। ভেঙ্গে পড়া গাছ, ল্যাম্প পোস্ট সরিয়ে দ্রুত অবরুদ্ধ রাস্তাগুলো চালু করার কাজ চলছে,” বলেন তিনি।

এদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় পানির চাপে ভেঙ্গে গেছে বেড়ি বাঁধ, তলিয়ে গেছে গ্রাম। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ফসলের। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে উপকূলীয় বিস্তীর্ণ জনপদে। যোগাযোগ ব্যবস্থারও ক্ষতি হয়েছে।

উখিয়ায় বিধ্বস্ত একশ ঘর

জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বেনারকে বলেন, “ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে কক্সবাজারের উখিয়ায় শরণার্থীর শিবিরে শতাধিক পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়েছে। এতে প্রায় চারশ মানুষ আশ্রয়হীন হয়েছে। বর্তমানে তারা আত্মীয়–স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।”

“এ ছাড়া বিভিন্ন শিবিরের আরো শতাধিক ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ঘরবাড়ি মেরামতের কাজ চলছে এবং তাদের মানবিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে,” বলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দুই দফায় এদের ৩০৫ জনকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে না পাঠিয়ে নোয়াখালীর ভাসানচরে পাঠায় সরকার।

কক্সবাজার থেকে লাখ খানেক রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানোর জন্য সেখানে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে সরকার। তবে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার আপত্তির কারণে এর আগে সেখানো কোনো রোহিঙ্গাকে পাঠানো যায়নি।

ভাসানচরে থাকা ওইসব রোহিঙ্গারা ঘূর্ণিঝড় আম্পানের মুখে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন জানিয়ে তাঁদেরকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে স্থানান্তর করার আহ্বান জানায় মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

বুধবার এক বিবৃতিতে সংস্থাটির এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, “সমুদ্রে ভাসমান রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ সরকার যথাযথভাবে তীরে এনেছে, কিন্তু ভয়াবহ সাইক্লোনের সময় তাঁদেরকে একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে আটকে রাখা বিপজ্জনক ও অমানাবিক।”

“আমাদের আশঙ্কা, প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকা ওই চরটি একটি ‘ভাসমান আটকন্দ্রে’ পরিণত হবে।”

তবে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে রোহিঙ্গাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে বৃহস্পতিবার জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান।

“ভাসানচরে কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। ওই চরটি খুবই সুরক্ষিত,” বলেন প্রতিমন্ত্রী।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।