ইয়াবা এখন বাংলাদেশের এক নম্বর মাদক সমস্যা
2017.08.02
ঢাকা

ফেনসিডিল ও হেরোইনকে পেছনে ফেলে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে আসা ইয়াবা ট্যাবলেট এখন বাংলাদেশের এক নম্বর মাদক সমস্যা বলে জানিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
গত বছর ভারত সরকার সেদেশে ফেনসিডিল উৎপাদন ও বিতরণের ওপর কড়াকড়ি আরোপের পর সেই স্থান ইয়াবা দখল করে নিয়েছে বলে বেনারকে জানান অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন আহমেদ।
তিনি বলেন, “ইয়াবা এখন বাংলাদেশের এক নম্বর মাদক সমস্যা। ইয়াবা ট্যাবলেট পাচার হয়ে বাংলাদেশে আসার একমাত্র রুট হলো বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত।”
“দুবছর আগেও ফেনসিডিল ছিল আমাদের দেশের প্রধান মাদক সমস্যা। এখন সেই স্থান দখল করে নিয়েছে ইয়াবা। ফেনসিডিল তরল; তাই ভারী ও সহজে বহনযোগ্য নয়,” বলেন মহাপরিচালক।
২০০৬ সালে প্রথম বাংলাদেশে ইয়াবা ধরা পড়ার পর থেকে এর প্রকোপ ক্রমেই বেড়ে চলেছে জানিয়ে এর ব্যাপক বিস্তারের অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “এটি সহজে বহনযোগ্য এবং তুলনামূলকভাবে দামে কম।”
“একটি মোবাইল ফোনের কেসের মধ্যে ২০০ ইয়াবা ট্যাবলেট বহন করা যায়। আবার মানি ব্যাগের মধ্যে ইয়াবা ট্যাবলেট বহন করা যায়,” বলেন জামাল উদ্দীন।
ইয়াবার প্রবাহ ঠেকাতে মিয়ানমারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনায় বসার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।
অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালে আট লাখের কিছু বেশি সংখ্যক ইয়াবা পাচারের সময় ধরা পড়ে। ২০১৫ সালে ধরা পড়ে দুই কোটির বেশি পিস ইয়াবা। আর ২০১৬ সালে প্রায় তিন কোটি ইয়াবা পাচারের সময় ধরা পড়ে।
বেকার ও তরুণরাই প্রধান শিকার
দেশের মাদকাসক্তদের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও মাদক ব্যবহারকারীদের শতকরা আশিজনের বেশি যুবক-যুবতী বলে বেনারকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
“বিভন্ন হিসাব অনুযায়ী মাদক গ্রহণকারীদের শতকরা আশি জন যুবক-যুবতী। আমাদের মাদক সমস্যার মধ্যে ইয়াবাই এখন প্রধান,” বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
“আমাদের কাছে যেসব মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য আনা হয় তাদের অধিকাংশই ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, প্যাথেড্রিন আসক্ত। এরা প্রায় সবাই ২০ থেকে ২২ বছর বয়সের,” বেনারকে বলেন ঢাকার শেওড়াপাড়ায় অবস্থিত এক মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের ডাক্তার মোহাম্মদ আসিফ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ (২০১৪) বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ১০ জন মাদক ব্যবহারকারীর ছয়জনের বেশি মানুষ কোনো অর্থ উপার্জন করে না। মাসিক ৩০ হাজার টাকার বেশি আয় করা মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা শতকরা মাত্র ১৬ ভাগ (১০ জনের মধ্যে ১.৬ জন)।
সব মাদকই বিদেশি
ইয়াবা ছাড়াও বাংলাদেশে ব্যবহৃত মাদকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হেরোইন, ফেনসিডিল, প্যাথেড্রিন, বিভিন্ন ধরনের ইনজেকশন, গাঁজা, আফিম, ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে ইয়াবার বিস্তার রোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
বাংলাদেশে ব্যবহৃত মাদকের কোনোটিই বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় না বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
“ভৌগলিক অবস্থার কারণে বাইরে থেকে মাদক বাংলাদেশে প্রবেশ করে,” বলেন তিনি।
কোডিন নামক রাসায়নিক দিয়ে প্রস্তত ফেনসিডিল কফ সিরাপ বাংলাদেশে নেশার কাজে ব্যবহৃত হলেও এর উৎপাদন হয় ভারতে।
বাংলাদেশের অনুরোধে ভারত সরকার সেদেশে ফেনসিডিল উৎপাদনের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে এবং ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ভারত সরকার ফেনসিডিল উৎপাদন নিষিদ্ধ করে। এরপর থেকে বাংলাদেশে ফেনসিডিলের প্রভাব কমে গেছে বলে জানান মহাপরিচালক।
১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে গাঁজা উৎপাদন বন্ধ করে দেয় সরকার। এরপর থেকে গাঁজাসহ আফিম, ফেনসিডিল, প্যাথেড্রিন সকল প্রকার মাদকদ্রব্য ভারত অথবা মিয়ানমার দিয়ে প্রবেশ করে।
ঝুঁকিতে দেশের অর্ধেক
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৬৪টির মধ্যে ৩২টি জেলা মাদক অপব্যবহারের ঝুঁকিতে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও সাতক্ষীরা জেলা।
এদিকে প্রায় প্রতিদিনই কক্সবাজার থেকে উদ্ধার হচ্ছে হাজার হাজার পিস ইয়াবা। সর্বশেষ গত বুধবার টেকনাফ এলাকায় প্রায় আশি হাজার পিস ইয়াবা মিয়ানমার থেকে পাচারের সময় উদ্ধার করা হয় বলে বেনারকে জানিয়েছেন বিজিবির অতিরিক্ত কমান্ডার শরীফুল ইসলাম জোমাদ্দার।
সিউডোএফিড্রিন নামক রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে প্রস্তুত লাল রঙের ইয়াবা ট্যাবলেট দেশের তরুণ-তরুণীদের একটি বিরাট অংশ যৌন উদ্দীপক হিসাবে ব্যবহার করে থাকে।
চিকিৎসকদের মতে, এই ট্যাবলেট ব্যবহার করলে একজন মানুষ ঘুমাতে পারে না এবং দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে ব্যবহারকারী একসময় পাগল হয়ে যায়।
“দেখুন, গাঁজাখোর বা আফিমসেবীদের কাউন্সেলিং করে সুস্থ করা যায়। কিন্তু ইয়াবা, হেরোইন, প্যাথেড্রিন, ইত্যাদি নেশা মারাত্মক। এদের সুস্থ করা খুবই কঠিন,” বেনারকে বলেন সংসদ সচিবালয় প্রধান মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. রফিকুর রহমান।