ভূমিধসের ঝুঁকিতে থাকা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্থানে সরানো হচ্ছে
2019.07.08
ঢাকা ও কক্সবাজার

পাহাড় ধসে মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি হওয়ার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে শুরু করেছে প্রশাসন। শনিবার থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
“ভারী বর্ষণ শুরু হওয়ায় দুর্ঘটনা এড়াতে গত শনিবার থেকে তাৎক্ষণিক ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের সরিয়ে অন্য আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে,” বেনারকে বলেন কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম।
“কত সংখ্যক রোহিঙ্গা ভূমি ধসের ঝুঁকিতে আছে এবং কতজনকে সরানো হয়েছে সেটি তালিকা শেষে বলা যাবে। আপাতত যারা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে, দ্রুত সরানোর প্রক্রিয়া চলছে,” জানান সরকারের এই কর্মকর্তা।
“পাহাড়ি এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বসবাস গড়ে ওঠায় ভারী বর্ষণে সেখানে ভূমি ধসের কিছুটা ঝুঁকি রয়েছে। তবে এই বর্ষায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে,” বলেন আবুল কালাম।
চার দিনে তিন রোহিঙ্গা নিহত
গত চার দিনে ভারী বৃষ্টির পানির ঢল ও পাহাড় ধসে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে তিনজন নিহত হয়েছেন। এদের দুই শিশু ও একজন নারী। এ ছাড়া ভারী বর্ষণে গত চার দিনে পানিতে তলিয়ে গেছে পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি।
ভূমিধসে নিহতরা হলেন কুতুপালং ২ নম্বর ক্যাম্পের ব্লক-ডি এর মৃত আবু বক্করের স্ত্রী মোস্তফা খাতুন (৫০), উখিয়া হাকিম পাড়া ক্যাম্পের মোহাম্মদ হামিম (৮) ও মধূর ছড়া ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইব্রাহীম (৭)।
উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের নিহতের সংখ্যা ও পরিচয় নিশ্চিত করেন।
এদিকে সোমবারের বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে পার্বত্য রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলায় এক নারী ও এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন জেলা প্রশাসক একে এম মামুনুর রশীদ।
নিহতরা হলেন ওই এলাকার সুনীল মল্লিকের তিন বছরের ছেলে উজ্জ্বল মল্লিক এবং তাহমিনা (২৫)।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস এর চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ বেনারকে বলেন, “গত কয়েকদিনে বর্ষার শুরুতে ভূমিধস ও পাহাড়ি ঢলে নালায় দুই শিশুসহ তিনজন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েকশ ঝুপড়ি-ঘর। যেভাবে বৃষ্টিপাত হচ্ছে তাতে আরো প্রাণহাণির সম্ভাবনা রয়েছে।”
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মুখপাত্র জোসেফ সূর্য ত্রিপুরা বেনারকে জানান, “ভারী বর্ষণ শুরু হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলমান রয়েছে।”
“এখন পর্যন্ত কত পরিবারকে সরানো হয়েছে তা এখন বলা যাচ্ছে না। তবে গত বছরের হিসাব অনুযায়ী এক লাখের মতো রোহিঙ্গা ঝুঁকিতে ছিলেন,” বলেন তিনি।
কক্সবাজার আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য মতে, গত ৩ থেকে ৫ জুলাই পর্যন্ত তিন দিনে জেলায় ৫১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই ধরনের বৃষ্টিপাত আরও কয়েকদিন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, ২০১৭ সালে বর্ষায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৭০ জন মারা যান।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার সেনা অভিযান থেকে প্রাণে বাঁচতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেন।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফে ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নতুন পুরোনো মিলে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। কক্সবাজারের পাহাড় ও বন কেটে বাসস্থান তৈরি করে বসবাস করছে বিশাল সংখ্যক এসব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।
কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তা মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা ৮ হাজার একর জমি দখল করে বসতি গড়ে তুলেছে। যার বেশির ভাগই পাহাড় ও বন কেটে গড়েছে। টানা বৃষ্টিপাতে এসব জায়গায় বড় ধরনের ভূমিধসের আশঙ্কা থাকে।”
উল্লেখ্য, এসব কারণে বঙ্গোপসাগরের ভাসানচরে এক লাখ শরণার্থীকে স্থানান্তর করতে চায় সরকার। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী এর বিরোধিতা করছে।
সীমাহীন দুর্ভোগ রোহিঙ্গা শিবিরে
ভারী বৃষ্টিতে বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়া নো-ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রিত রোহিঙ্গা শিবির পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে দুর্ভোগে পড়েছে এখানে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১ হাজার ৩০০ রোহিঙ্গা পরিবারের পাঁচ হাজারের বেশি নারী-পুরুষ ও শিশু। দেখা দিয়েছে খাবার ও পানি সংকট।
তুমব্রু শূন্যরেখা রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “প্রবল বৃষ্টির পানির সাথে পাহাড়ি ঢল নেমে আসায় এখানকার শিবিরটি প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পানিতে তলিয়ে রয়েছে। বর্তমানে এখানে খাদ্য এবং খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। শিশুরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।”
জাদিমুড়া শালবন পাহাড়ের পাদদেশে আশ্রিত মোহাম্মদ আবু তাহের বেনারকে বলেন, “শনিবার রাত থেকে ভারী বর্ষণে পাহাড়ি ঢলের পানি ঘরে ঢুকে পড়ে। এতে পরিবারের ৮ সদস্যর রাতে নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে। ভূমিধসের ভয়ে পাহাড়ের পাদদেশের ঝুপড়ি ঘর ফেলে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজছি।”
জাদিমুড়া রাস্তার পাশের রোহিঙ্গা শিবিরের মাঝি মোহাম্মদ একরাম বেনারকে বলেন, “কদিনের ভারী বৃষ্টিপাতে অনেকের বাড়ির ঘরের ত্রিপলের ছাউনি নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই পানিতে ঘর ভিজে যায়। ফলে সন্তানদের নিয়ে বসে বসেই কাটাতে হয়।”
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিউল হাসান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা পাহাড় ও বন কেটে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করেছে, তাই ঝুঁকিটা বেশি। তবে ভারী বর্ষণে দুর্ঘটনা এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রোহিঙ্গা সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে।”
“আশপাশের মসজিদ, সাইক্লোন শেল্টার, আশপাশের স্কুলের ভবন প্রস্তুত রাখা হয়েছে,” বলেন তিনি।
বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে
আইওএম এর তথ্যমতে, ২ থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ১৮৬ টি বাড়ি, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ২১৬টি এবং ঝড়ো হাওয়ায় ১ হাজার ৮৪০ টি বাড়ি।
পুরো চলতি সপ্তাহজুড়ে বৃষ্টি এবং ঝড়ো হাওয়া অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানায় আইওএম।
ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক পরিমাণ ইতোমধ্যেই ২০১৮ সালের ক্ষয়ক্ষতির থেকেও বেশি জানিয়ে আইওএম এর মুখপাত্র জর্জ ম্যাকলয়েড বলেন, “বর্ষাকালের মাত্র অর্ধেক সময় পার হয়েছে। এরই মধ্যে গত ৭২ ঘন্টায় আমরা দুই হাজার মানুষকে সহায়তা করেছি। আমাদের সকল সদস্য সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।”