চলে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী
2018.03.06
ঢাকা

মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী (৭১) আর নেই। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবরে দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে।
প্রয়াতের মেয়ে ফুলেশ্বরী প্রিয় নন্দিনী বেনারকে জানান, “গত বছরের নভেম্বরে বাথরুমে পড়ে গোড়ালিতে চোট পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি করার পর মায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়। তিনি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ছাড়াও লিভার, কিডনিসহ জটিল বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন।”
ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে দুপুর পৌনে ১টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়। সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান হাসপাতালটির কর্মকর্তা সাইফুর লেনিন।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত এই নারী মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
দেশের মুক্তিসংগ্রামে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে জানিয়ে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন রাষ্ট্রপতি। পৃথক শোক বার্তায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ ও জাতি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর অবদান চিরদিন মনে রাখবে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে সাড়ে সাত মাস ধরে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে সমাজের নিষেধ অমান্য করে সেসব নির্যাতনের অভিজ্ঞতা সবার সামনেও তুলে ধরেছিলেন সাহসী এই নারী। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর মতো নির্যাতনের শিকার সব নারীকে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দেওয়ার দাবিও জানিয়েছিলেন তিনি।
“ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মতো সাহসী, মুক্তচিন্তার মানুষ বাংলাদেশে খুব বিরল। এ দেশের নারীদের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি। নিজের জীবন নিয়ে এতখানি বীরত্ব প্রকাশ খুব কঠিন ব্যাপার, যা তিনি করে দেখিয়েছেন,” বেনারকে বলছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত গণসংগীতশিল্পী, মুক্তিযোদ্ধা ও উদীচীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ সেলিম।
“যেকোনো মানবাধিকার সংক্রান্ত সকল কাজেও প্রিয়ভাষিণীকে সামনের কাতারে পাওয়া গেছে,” বলেন তিনি।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মতো সাহসী নারীর হঠাৎ করে চলে যাওয়ায় দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল বলে মনে করেন আরেক মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও সংগঠক কামাল লোহানী।
১৯৪৭ সালে খুলনায় জন্ম নেওয়া ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী শিক্ষকতাসহ দেশি, বিদেশি ও বহুজাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। পরে শিল্পের সাধনায় মন দেন তিনি। প্রকৃতিনির্ভর শিল্পকর্মই তাঁর কাজের বৈশিষ্ট্য। ঝরা পাতা, শুকনো ডাল, গাছের গুঁড়ি প্রভৃতি উপকরণ দিয়ে গৃহসজ্জা ও শিল্পকর্ম করতেন এই ভাস্কর।
প্রিয়ভাষিণী ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহ-সভানেত্রী হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সক্রিয় থেকেছেন দীর্ঘদিন। দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে তিনি রিডার্স ডাইজেস্ট পত্রিকার ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রচ্ছদে সাহসিকতার জন্যে ‘নায়ক’ উপাধি লাভ করেন।
২০১০ সালে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তবে এরও অনেক পরে ২০১৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন ফেরদৌসী। ২০১৪ সালে তাঁর আত্মজীবনী ‘নিন্দিত নন্দন’ প্রকাশিত হয়।
প্রিয়ভাষিণীর মরদেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলের হিমঘরে রাখা হয়েছে। ছয় সন্তানের মধ্যে ছোট ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় থাকায় তার ফেরার পরেই তাঁকে সমাহিত করা হবে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মোহাম্মদ সামাদ সাংবাদিকদের জানান, “প্রিয়ভাষিণীর ছেলে কাজী মহম্মদ শাকের তূর্য বৃহস্পতিবার অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরবেন। এদিন সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বেলা ১১টা থেকে এক ঘণ্টা প্রিয়ভাষিণীর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে।”
“বৃহস্পতিবারেই বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজার পরে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে,” বেনারকে জানান গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।