উৎসবে দেশের হলে বিদেশি সিনেমা দেখানো যাবে না: সুপ্রিম কোর্ট
2018.05.30
ঢাকা
এবারের ঈদে দেশের সিনেমা হলে বিদেশি কোনো চলচ্চিত্র দেখতে পারবে না বাংলাদেশের দর্শকরা। বুধবার এ সংক্রান্ত এক বিচারিক আদেশ জারি হয়েছে।
“দেশের প্রধান চার পার্বণ, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, পূজা ও পহেলা বৈশাখের সময় ভারতীয় বাংলা, হিন্দি, পাকিস্তানিসহ বাইরের দেশের যে কোনো চলচ্চিত্র আমদানি, প্রদর্শন ও বিতরণ যাবে না,” বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
তবে “যৌথ প্রযোজনার নীতিমালায় নির্মিত সিনেমা” এই নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে।
হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ স্থগিত চেয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ও মধুমিতা সিনেমা হলের স্বত্বাধিকারী ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের করা আপিলের আবেদন নিষ্পত্তিকালে এ আদেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের বেঞ্চ।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বেনারকে বলেন, “এই আদেশ দেশীয় নির্মাতা, প্রযোজক ও কলা-কুশলীদের জন্য খুবই ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।”
তবে আপলিকারী ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের অভিমত, “এই আদেশের মাধ্যমে দেশের হল মালিকদের ব্যবসার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।”
এর আগে প্রযোজক সেলিম খানের স্ত্রী সেলিনা বেগমের রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১০ মে যৌথ প্রযোজনাসহ সকল প্রকার বিদেশি সিনেমা আমদানি ও প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে হাইকোর্ট।
এই আদেশ স্থগিত চেয়ে করা আপিলের আবেদনটি প্রথমে চেম্বার জজ আদালতে পাঠানো হয়। পরে তা আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে গেলে বুধবার এই নতুন আদেশ আসে।
আদালতে রিট আদেশের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী আজমালুল হক কিউসি। তার সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার এম. মনিরুজ্জামান আসাদ। অন্যদিকে আপিলকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এএম আমিন উদ্দিন।
এম. মনিরুজ্জামান আসাদ সাংবাদিকদের বলেন, “বিদেশি সিনেমা আমদানি ও প্রদর্শনের ফলে দেশি সিনেমায় দর্শক পাওয়া যাচ্ছে না বিধায় সংক্ষুব্ধ হয়ে রিট দায়ের করেছিলেন সেলিনা। যার প্রেক্ষিতে যৌথ প্রযোজনাসহ সব ধরনের বিদেশি সিনেমার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন হাইকোর্ট।”
“হাইকোর্টের সেই আদেশ কিছুটা মোডিফাই করেছেন আপিল বিভাগ,” উল্লেখ করে আসাদ আরও বলেন, “এই আদেশের পর উৎসবের সময়ে দেশের হলগুলোয় যৌথ প্রযোজনার ছবি চলতে বাধা নেই। তবে আমদানি করা সিনেমা প্রদর্শনে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকছে।”
“চলচ্চিত্র আমদানি বন্ধে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। কারণ এসব সিনেমা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য ক্ষতিকর,” বলেন নির্মাতা গুলজার।
যদিও নওশাদ বেনারকে বলেন, “আমরা নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মেরেছি। এক সময় প্রতিযোগিতা ছিল বলেই এখানে ভালো সিনেমা তৈরি হয়েছে।”
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বেনারকে জানান, এই রায়ের ফলে আসন্ন ঈদে কলকাতায় নির্মিত ‘ভাইজান এলো রে’ এবং ‘সুলতান’ নামের দুটি ছবির বাংলাদেশে মুক্তি পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
তবে স্থানীয় নির্মাতা-প্রযোজকদের তৈরি কমপক্ষে চারটি সিনেমা মুক্তির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়ে গুলজার বেনারকে বলেন, “এর মধ্যে দুটি চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্রও পেয়ে গেছে।”
তাঁর দাবি, বর্তমানে দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা যা, তাতে উৎসবের সময়ে চারটির বেশি সিনেমা রিলিজ দিলে ব্যবসা করা যাবে না।
নওসাদ বেনারকে জানান, বর্তমানে দেশের ৩২৫টি সিনেমা হল সচল রয়েছে। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে আরও ৩০-৩৫টি হল সাময়িক সময়ের জন্য চালু হয়।
যৌথ প্রযোজনা নিয়েও আপত্তি
“আপিল বিভাগের আদেশটি আরও ইতিবাচক হতো, যদি যৌথ প্রযোজনাও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেত। দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিজকে বাঁচাতে এ ছাড়া কোনো উপায় নেই,” বেনারকে বলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন জেমী।
তিনি মনে করেন, “আমদানি করা বিদেশি চলচ্চিত্রের মতো যৌথ প্রযোজনার ছবিও আমাদের পার্বণগুলোর সময় অন্তত নিষিদ্ধ থাকা উচিত। তাহলে দেশীয় নির্মাতারা উৎসাহিত হবেন।”
অন্যদিকে গুলজার বলেন, “রিলিজের সময় আমাদের লোকাল ছবিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কোনো ঈদ বা পূজায় সময় নিজস্ব সিনেমার সংখ্যা কম থাকলে সে ক্ষেত্রে যৌথ ছবিগুলোকে সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।”
গুলজার এবং জেমী দাবি করেন, ‘যৌথ প্রযোজনার নামে মূলত ‘যৌথ প্রতারণা’ হচ্ছে। দেশীয় কিছু দালালের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সিনেমাগুলোকে কাগজপত্রে যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত দেখানো হচ্ছে।
জেমীর দাবি, “এতে ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি হচ্ছে, সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে।” যদিও গুলজার উল্লেখ করেন, “নিয়ম মেনে যৌথ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হলে তা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য ক্ষতিকর না।”
অন্যদিকে চলচ্চিত্র শিল্পের রুগ্ন দশার জন্য স্থানীয় নির্মাতাদেরও দায়ী করেন নওশাদ। তিনি বলেন, “তারা ভালো ‘কন্টেন্ট’ তৈরি করতে পারছেন না। তাদের একচেটিয়া বাজার দর্শকদের আরো হল বিমুখ করবে।”
মৃতপ্রায় সিনেমা হল মালিকেরা আদালতের নতুন আদেশে হতাশ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “আরও অনেকে হল বন্ধ বা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হবেন।”
‘অ্যালার্জি’ নেই হলিউড সিনেমায়
“আইনজীবীরা ভুল তথ্য দিয়েছেন,” দাবি করে স্টার সিনেপ্লেক্সের মিডিয়া ও বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “আদালতের আদেশে সম্ভবত ভারতীয় ও পাকিস্তানি সিনেমার কথা বলা হয়েছে। হলিউডের সিনেমা প্রদর্শন নিয়ে আপত্তি থাকার কথা নয়।”
নওশাদ বলেন, “হলিউডের সিনেমার ক্ষেত্রে হয়তো এই আদেশ প্রযোজ্য হবে না। হলিউডি সিনেমা নিয়ে কারও কোনো অ্যালার্জি নেই। মূল সমস্যা ভারতীয় বাংলা সিনেমা নিয়ে।”
মেজবাহ বলেন, “আমরা যদ্দুর জেনেছি ঈদে কলকাতার দুটি সিনেমা এখানে রিলিজ দেওয়া নিয়েই সমস্যার শুরু।”
“সরকারের আমদানি নীতিমালা মেনে, সরকারকে সব ধরনের কর পরিশোধ করে হলিউডের সিনেমা আমদানি করা হয়,” বলেও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।
নওশাদ বলেন, “আমাদের দেশের জয়া আহসান বা শাকিব খান কলকাতায় ভালো অবস্থান গড়ে তুলেছেন। কিন্তু তাঁদের সিনেমা আমরা এখানে দেখাতে পারছি না।”