আগুনে নিহত ৫২: মরদেহ চেনার উপায় নেই, অপেক্ষা ডিএনএ পরীক্ষার

শরীফ খিয়াম
2021.07.09
ঢাকা
আগুনে নিহত ৫২: মরদেহ চেনার উপায় নেই, অপেক্ষা ডিএনএ পরীক্ষার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
বেনার নিউজ

মোহাম্মদ চাঁন মিয়া ও নাজু আক্তারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনজনই নারায়ণগঞ্জের সজীব গ্রুপের হাসেম ফুডস লিমিটেডের জুস কারখানায় কাজ করতেন। কারখানার প্রধান ফটকে বৃহস্পতিবার সকালে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল তাদের।

ওই কারখানায় বৃহস্প​তিবার রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে তিন ভাইবোন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে​ন। তাদের একজন শফিকুল ইসলাম (১৮) দুই ভাইবোনকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন শুক্রবার দিনভর। এরপর তার গন্তব্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ।

ঢাকার পাশ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জে ওই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ৫২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ১২ জনের প্রাণ নেওয়া মগবাজার ওয়্যারলেস মোড়ের ভয়াবহ বিস্ফোরণের ১০ দিন পর মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হলেন এই অর্ধশতাধিক শ্রমিক।

শফিকুলের মতো আরো অনেক স্বজন শুক্রবার জড়ো হয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। তাদের কেউই লাশ বুঝে পাননি। 

5.jpg
অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের মৃতদেহ বের করে আনছেন উদ্ধারকর্মীরা । ছবি: মোহাম্মদ পনির হোসেন, রয়টার্স

ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) দেবাশীষ বর্ধন সাংবাদিকদের জানান, আগুনে নিহতদের কাউকেই শনাক্ত করার উপায় নেই। লাশগুলো এতোটাই বিকৃত হয়েছে যে, সেগুলো চেনা যায় না।

“লাশগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সেখানে ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) পরীক্ষার মাধ্যমে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে,” বলেন তিনি।

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুভাষ চন্দ্র সাহা জানান, স্বজনদের সঙ্গে ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে পরে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।

কিশোরগঞ্জ সদরের মথিয়া ইউনিয়নের কালিয়ার কান্দা গ্রামের ওই তিন ভাই বোন রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতার কর্ণগোপ এলাকার ওই কারখানায় কাজ করতেন। অগ্নিকাণ্ডের পর বড় বোন সাগরিকা খাতুন (১৯) এবং ছোট ভাই নাজমুল হোসেনের (১৫) খোঁজ পাননি শফিকুল ইসলাম।

2.jpg
অগ্নিকাণ্ডে নিহত স্বজনদের আহাজারি প্রথম আলো। জুলাই ৯। নারায়ণগঞ্জ। ছবি: রয়টার্স

এরপর আগুন নেভার জন্য টানা ২০ ঘন্টার অপেক্ষা শেষে শুক্রবার দুপুর আড়াইটার দিকে তারা স্বজনদের সন্ধান জানতে পারেন।

বেনারকে শফিকুল বলেন, “বাড়ি থেকে আমাকে ফোন করে জানালো যে, বোন মারা গেছে। তাঁর লাশ ঢাকা মেডিকেলে আছে।”

কঠোর লকডাউনের মধ্যে ভেঙ্গে ভেঙ্গে রিক্সায় করে শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া ছয়টা নাগাদ বোনের জামাইকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছান শফিক।

“আমাদের লাশ দেখতে দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে মা অথবা বাবাকে আনতে হবে। পরিচয় জানতে নাকি ডিএনএ পরীক্ষা করা লাগবে,” সন্ধ্যায় বেনারকে বলেন শফিকুল।

“এখন কিছুই বুঝতে পারছি না। মা-বাবাকে কী জানাবো, তাদের কীভাবে গ্রাম থেকে আনব সেটাও বুঝতে পারছি না,” বলেন শফিকুল।

শফিকুল ও তাঁর বোন ওই কারখানায় কয়েক বছর ধরে কাজ করছিলেন। তাদের ছোট ভাই নাজমুল তিন মাস আগে সেখানে কাজে যোগ দেয়, সেও নিখোঁজ রয়েছে।

4.jpg
অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্থ কারখানায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জুলাই ৯। নারায়ণগঞ্জ। ছবি: রয়টার্স

আরেক নিখোঁজ শ্রমিক মো. ইয়াসিন খান রিপনের (১৭) স্বজনেরাও শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে পৌঁছেছেন। তিনি ছিলেন কারখানা সংলগ্ন গোলাকান্দাইল পাঁচ নম্বর ক্যানেল এলাকার বাসিন্দা।

রিপনের বড় ভাই মো. ইসমাইল হোসেন (২৫) বেনারকে জানান, “কারখানা থেকে লাশগুলো নেওয়ার সময়ই আমাদের বলা হয়েছিল ‘ডিএনএ টেস্ট’ করতে হবে। এ ছাড়া কোনটা কার লাশ তা বোঝার কোনো উপায় নেই আসলে।”

মুঠোফোনে বেনারকে তাঁদের শৈশবের বিভিন্ন গল্প বলতে বলতে বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ইসমাঈল। স্বামী পরিত্যাক্তা মা গার্মেন্টসে কাজ করে তাঁদের বড় করেছিলেন বলেও জানান তিনি।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ জায়েদুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এক বা একাধিক মামলা হতে পারে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো: মোস্তাইন বিল্লাহ-এর বরাত দিয়ে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) দাবি করেছে, এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আরো অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। 

8.jpg
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কারখানার ভেতরে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। জুলাই ৯। নারায়ণগঞ্জ। ছবি: রয়টার্স

ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে উল্লেখ করে ডিসি নিহতদের পরিবারপ্রতি ২৫ হাজার টাকা ও গুরুতর আহতদের পরিবারকে দশ হাজার টাকা দেওয়ার কথা জানান।

এ ছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান শুক্রবার বিকেলে এক বার্তায় শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে নিহতদের স্বজনদের সহায়তার ঘোষণা দেন।

ওই ঘটনার পর পৃথক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনার পাশাপাশি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ ও আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছেন তারা।

6.jpg
ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীর বিশ্রাম নিচ্ছেন। জুলাই ৯। নারায়ণগঞ্জ। ছবি: রয়টার্স

বিক্ষোভ, সংঘর্ষ

আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরি হওয়ায় শুক্রবার বিক্ষুদ্ধ স্বজনদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।

বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে সূত্রপাত হওয়া এই আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট যুক্ত হয়।  দীর্ঘ প্রায় ২০ ঘণ্টার চেষ্টায় শুক্রবার দুপুরের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনেরা কারখানার সামনে অপেক্ষা করছিলেন। আগুন নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘ সময় লাগায় বিক্ষুব্ধ স্বজন ও স্থানীয়রা কারখানায় হামলাও চালায়। এসময় সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য আহত হন।

পুলিশ জানায়, ঘটনার সময় আটটি মোটরসাইকেল এবং অন্তত ২০টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ।

9.jpg
ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের ক্লান্ত কর্মী। জুলাই ৯। নারায়ণগঞ্জ। ছবি: রয়টার্স

ভবনটিতে আগুন নেভানোর সরঞ্জাম ছিল না

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় সজীব গ্রুপের ওই কারখানায় জুস ও বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী তৈরি করা হত। ভবনটিতে আগুন নেভানোর সরঞ্জাম যেমন ছিল না, তেমনি জরুরি বের হওয়ার প্রয়োজনীয় সংখ্যক পথও রাখা হয়নি বলে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

শুক্রবার বিকালে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক অপারেশন্স লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “ভবনটির আয়তন প্রায় ৩৫ হাজার বর্গফুট। ওই ভবনের জন্য অন্তত চার থেকে পাঁচটি সিঁড়ি থাকা দরকার ছিল।”

7.jpg
অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্থ কারখানার ভেতরের দৃশ্য। জুলাই ৯। নারায়ণগঞ্জ। ছবি: রয়টার্স

“অথচ বড় এই ভবনে আমরা পেলাম মাত্র দুটি এক্সিট। এর মধ্যে প্রথম এক্সিট ছিল আগুনের মধ্যে। শুরুতেই সেটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সেখানে থেকে কেউ বাইরে যেতে পারেনি,” যোগ করেন তিনি।

দ্বিতীয় সিঁড়ির কাছেও তাপ ও ধোঁয়ার কারণে ভেতরে আটকে থাকা শ্রমিকেরা যেতে পারেননি বলে মনে করেন ওই কর্মকর্তা।

ভবনটিতে ফায়ার সেফটি ইকুইপমেন্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তদন্তের সময় বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবনটিতে অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছিল কিনা, তা দেখা হবে।

প্রাথমিকভাবে আগুনের উৎস সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসসহ কোনও কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হতে পারেনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।