দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
2017.07.07

আপডেট: ইস্টার্ন টাইম জোন বিকেল ৫.৩০
অতি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বাংলাদেশে দুদিনে (বুধ ও বৃহস্পিতবার) চার শিশুসহ ৬ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে চরম দুরবস্থায় পড়েছে লাখ লাখ পানিবন্দী মানুষ।
সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ত্রাণ তৎপরতা শুরু করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী ও ভুক্তভোগীরা।
তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া জনসাধারণকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, “দুর্গত মানুষের সহায়তায় সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং যত দিন প্রয়োজন ততদিন ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চলবে।”
“দুর্গত মানুষের খাদ্য, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেবে সরকার। যতদিন বন্যা থাকবে ততদিন সরকার সবকিছু দিয়ে যাবে,” মন্ত্রী বেনারকে জানান।
এরই মধ্যে সরকার দেড় হাজার মেট্রিক টন চাল, নগদ ৪৪ লাখ টাকা ও শুকনো খাবার বরাদ্দ দিয়েছে। পাশাপাশি, বন্যা প্রবণ ২১টি জেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দুই হাজার একশ টন চাল ও আগাম ৪২ লাখ টাকা বিতরণ করেছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
এদিকে দীর্ঘ মেয়াদি বন্যার কারণে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে সিলেট ও মৌলভীবাজার এলাকা। তলিয়ে গেছে কক্সবাজার জেলার বড় একটি অংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পাহাড়ি ঢলে হাওরের বন্যার পর থেকে তাদের দুর্ভোগ লেগে আছে। সিলেট ও চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও পানি বাড়ছে দেশের উত্তরাঞ্চলে। নদনদীর পানির উচ্চতা বাড়ায় নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সিলেটের দুর্গত অঞ্চল ঘুরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেছেন, “সরকার দুর্গত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই। তবে, সেটা ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগবে।”
অর্থমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস গতকাল বলেছে, “দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বিতরণের জন্য সরকার ৫০ লাখ পরিবারকে ভিজিএফ সহায়তা দিচ্ছে। কোনো কোনো জায়গায় ৩ ও ৬ মাস মেয়াদি এই সহায়তা প্রয়োজনে আরও বাড়ানো হবে।”
কক্সবাজার পরিস্থিতি
গত কয়েকদিনের বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজার জেলার আট উপজেলার ৭১টি ইউনিয়নের প্রায় ৯শ’ গ্রাম ডুবে গেছে। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক পানিতে ডুবে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
চকরিয়া উপজেলার বহু মৎস্য খামার তলিয়ে গেছে। বন্যার পানিতে ডুবে ও পাহাড় ধসে চার শিশুসহ ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার বন্যার পানিতে ডুবে রামুতে দুই জন এবং উখিয়ায় তিন জনের মৃত্যু হয়েছে।
এ ছাড়া গত বুধবার রাতে উখিয়ায় পাহাড়ধসে মারা গেছে এক শিশু। আরও একজন নিখোঁজ রয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরী।
তিনি বলেন, “আমরা সাধ্যমতো দুর্গতদের সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছি। তবে সরকার যে সাহায্য পাঠাচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।”
জেলাটির অন্তত ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে বলে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বীজতলা, ফসলি জমি এবং চিংড়ি ঘের তলিয়ে গেছে। জেলার প্রধান নদী মাতামুহুরি, বাঁকখালী, কোহালিয়া ও নাফ নদীর পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নদীতে পানি বেড়েছে বলে বেনারকে টেলিফোনে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.সবিবুর রহমান।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বেনারকে বলেন, “মানুষ যেন খাবার কষ্টে না ভোগে সে জন্য আমরা কাজ করছি। দুর্গত এলাকায় বণ্টনের জন্য নগদ ৪ লাখ টাকা, ৩৩মেট্টিন চাল ও খাদ্য সামগ্রী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।”
সিলেটের পরিস্থিতি
প্রায় এক মাসের বন্যায় সিলেটে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ। আবহাওয়ার উন্নতি না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে জানিয়েছেন সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.সিরাজুল ইসলাম।
জেলার ৯ উপজেলার ৫ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সেখানে কর্মরত ডেইলি অবজারভার পত্রিকার সাংবাদিক সরদার আব্বাস। তিনি বলেছেন, “সিলেট, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের অন্তত ৫৫২৬ হেক্টর জমির ফসল ডুবে গেছে।”
ত্রাণ তৎপরতা চললেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন তিনি।
সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদাল মিয়া বেনারকে বলেন, “ঘর-দুয়ারে পানি ওঠায় দুর্গতরা সীমাহীন কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।” তিনি বলেন, “আমরা নৌকা নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করছি। কিন্তু যত দরকার তত ত্রাণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”
তিনি বলেন, সরকারিভাবে কিছু এলাকায় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। কিন্তু সব মানুষ সেখানে আসবে কীভাবে? বাড়িঘর, জিনিসপত্র হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল ফেলে কেবল জানটা নিয়ে সবাই আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে চায় না।”
সিলেট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মফজুলের রহমান বেনারকে বলেছেন, “চাল, ডাল, চিনি, গুড়, চিড়া, সয়াবিন তেল, লবণ, মোমবাতি ও দেশলাই প্যাকেটজাত করে বন্যাকবলিত গ্রামে বিতরণ করা হচ্ছে।”
“মোট ৭৮টি মেডিকেল টিম দুর্গতদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে,” বেনারকে জানিয়েছেন সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. হিমাংশু লাল রায়। আরও ৭০টি টিম স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
উত্তরাঞ্চলের অবস্থা
কুড়িগ্রামের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
“ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তাসহ অববাহিকার সব কটি নদীতে পানির উচ্চতা প্রতিদিন বাড়ছে,” বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিক পরিমল মজুমদার।
সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানির তোড়ে ভেঙে গেছে জামালপুরে এম আর সি প্রকল্পের পাইলিং বাঁধ। সেখানে যমুনা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমা প্রায় ছুঁই ছুঁই করছিল। আর মাত্র ১৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেলে বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হবে বলে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে।
কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. রুহুল আমিন বেনারকে বলেছেন, “চর এলাকাগুলোতে মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। আমরা নদী ভাঙা দরিদ্র পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছি।”
আরও বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস
দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর পূর্বাভাস দিয়েছে। অধিদপ্তর বলেছে, শুক্রবার সকাল ৯ টা থেকে পরবর্তী ৭২ ঘন্টায় দেশে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
অধিদপ্তরের বুলেটিনে বলা হয়, “রংপুর ও খুলনা বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী বর্ষণ হতে পারে।”