বন্যায় প্লাবিত দেশের অর্ধেকের বেশি জেলা, ত্রাণ সংকটের অভিযোগ
2017.08.18
ঢাকা

বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে বন্যায় ৩৬টি জেলা প্লাবিত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বন্যায় মারা গেছে ৮২ জন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৫১ লাখের বেশি মানুষ।
গতকাল শুক্রবার উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও পানি বাড়ছে দেশের মধ্যাঞ্চলে। পদ্মাসহ বেশ কিছু নদীর পানি বাড়তে থাকায় ঢাকার নিম্নাঞ্চলও প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
এদিকে বন্যা দুর্গত এলাকায় তীব্র ত্রাণ সংকটের অভিযোগ উঠেছে। তবে পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে বলে দাবি করেছে সরকার। এই পরিস্থিতিতে আগামীকাল রোববার দেশের সবচেয়ে উপদ্রুত এলাকা দিনাজপুর ও কুড়িগ্রাম পরিদর্শনে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেন, “প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে। ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাবার উঠছে না। আশ্রয় মিলছে না। বহু এলাকায় কোনো ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছায়নি। সরকার বানভাসি মানুষের দুর্দশা লাঘবে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।”
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে পরিচালক আবু সাঈদ মোহাম্মদ হাশিম বেনারকে বলেন, “আমাদের ত্রাণের কোনো সংকট নেই। প্রতিটি জেলাতেই পর্যাপ্ত ত্রাণ রয়েছে।”
এদিকে পুনর্বাসন না হওয়া পর্যন্ত সরকার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
নীলফামারীর বন্যা উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে শুক্রবার তিনি বলেন, “ত্রাণ তৎপরতা চলবে, মেডিকেল টিম কাজ করবে, পুনর্বাসনও হবে।”
এদিকে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারে নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদ ও ত্রাণ জোরদারের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করায় গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের ওপর কয়েক দফা হামলার অভিযোগ উঠেছে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।
ইমরান সাংবাদিকদের বলেন, “সারা দেশের মানুষ বলছে বন্যা ভয়াবহ। ওরা বলছে, দেশে বন্যা নেই।”
ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ
বন্যা আক্রান্ত এলাকাগুলোতে ভেসে গেছে মানুষের বসতবাড়ি-গবাদিপশু আর ফসলি মাঠ। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট ও রেল তলিয়ে যাওয়ায় কয়েকটি জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের শুক্রবারের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় এখন পর্যন্ত ২৭টি জেলার ১৩৭টি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫১ লক্ষ ২৮ হাজার ৮৯১ জন। মারা গেছেন ৮১ জন। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানিয়েছে, ৩৬টি জেলায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এতে নিমজ্জিত ফসলি জমির পরিমাণ ছয় লক্ষ হেক্টরেরও বেশি।
দুর্যোগ অধিদপ্তরের হিসেবে, ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির পরিমাণ ৬ লক্ষ ৪৫ হাজার ২৯১ হেক্টর। ৮ হাজার ১৮০ মেট্রিক টন চাল, ২৮ হাজার চারশ মেট্রিক টন শুকনো খাবার ও নগদ ২ কোটি ৩১ লক্ষ ৩১হাজার পাঁচশ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বন্যার কারণে তিন হাজার ২৯৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
ঢাকায় বন্যার আশঙ্কা
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, দেশের উত্তর অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি ক্রমশ উন্নতি হলেও অবনতিশীল থাকবে দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের পরিস্থিতি। এ ছাড়া ঢাকার চারদিকে পাঁচটি নদীর পানি বিপদ সীমার কাছাকাছি থাকায় রাজধানীর নিম্নাঞ্চলও প্লাবিত হতে পারে।
কেন্দ্রের কেন্দ্রের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বেনারকে জানান, “ঢাকার চতুর্দিকের পাঁচটি নদীর পানি বিপদ সীমার ১৫ সে.মি হতে ১২০ সে.মি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই পানি আরও বৃদ্ধি পেলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্লাবিত হতে পারে।”
“আগামী ৭২ ঘণ্টা ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি কমতে থাকবে। এ সময়ে উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে। তবে আগামী ৪৮ ঘণ্টা পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাবে। এতে দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে বন্যার অবনতি হবে। তবে গঙ্গা-পদ্মার পানি বৃদ্ধি পেলেও তা বিপদ সীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে,” জানান তিনি।
এ ছাড়া নদ-নদীর ৯০টি পয়েন্টের মধ্যে ৪৬টির পানি হ্রাস, ৪৩টির বৃদ্ধি ও ১টি অপরিবর্তিত এবং ২৮টি পয়েন্টে পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
জেলায় জেলায় হাহাকার
উত্তরের কয়েকটি জেলায় বন্যার পানি কিছুটা নেমে গেলেও মানুষের হাহাকার থামেনি। জনপদগুলো যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। রাস্তার ওপর গাদাগাদি করে বসবাস করছে মানুষ আর গবাদিপশু। রয়েছে ত্রাণের জন্য হাহাকার।
দিনাজপুর জেলার বিরলের বাসিন্দা আবুল কাসেম বেনারকে বলেন, “বন্যার পানিতে আমার ঘর বিলীন হয়েছে, চারটি গরু মরেছে। আমন ধান লাগিয়েছিলাম সেগুলোও ভেসে গেছে।”
তবে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মীর খায়রুল আলম বেনারকে বলেন, “এ জেলায় আনুমানিক পাঁচ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁদের মাঝে ৬৯৫ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। এ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে।”
রংপুরে কৃষক ইসমাইল আলী বেনারকে বলেন, “টাকা ধার নিয়ে ১০ বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছিলাম। বানের পানিতে সব ভেসে গেছে।”
সুনামগঞ্জের মোহাম্মদ রফিক (৫৫) বেনারকে বলেন, “মার্চের বন্যায় আমার ১০ একর জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানি নামলে আমন চাষ করি। কিন্তু এবারের বন্যায় সে ফসলও ভেসে গেছে। আমি আবারও নিঃস্ব হয়ে গেলাম।”
খাদ্য সংকটের শঙ্কা
এদিকে বন্যায় লক্ষ লক্ষ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকার আমদানির কথা বললেও আন্তর্জাতিক বাজারের অবস্থা বিবেচনা করে পর্যাপ্ত চাল আনা আদৌ সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমাদের যথেষ্ট খাদ্য মজুত রয়েছে। তাই সংকট দেখা দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।”
“তা ছাড়া আরও ১৫ লাখ টন চাল এবং ৫ লাখ টন গম বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে,” বলেন তিনি।
তবে সরকারি উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের গবেষক নাজনীন আহমেদ বেনারকে বলেন, “এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারেই চাল কম। আমদানির চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু পর্যাপ্ত আমদানি করতে পারবে কি না সে ব্যাপারে শঙ্কা রয়েছে।”
“তা ছাড়া ভারতেও বন্যা হয়েছে, চীনেও ধানের উৎপাদন কম। প্রত্যেক দেশই নিজেদের মতো করে চালের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে চেষ্টা করছে,” বলেন তিনি।