সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবিলায় চাল আমদানি করছে বাংলাদেশ
2017.06.06
ঢাকা

গত কয়েক বছর অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে চাহিদা মেটানো গেলেও এবার হঠাৎ করেই বাংলাদেশে সরকারি চালের মজুত কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
সরকারের বর্তমান মজুত গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। মজুত কমে যাওয়ায় বাজারে চালের দাম হুট করে বেড়েছে। এখন বাজারে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা, যা মোটা চালের দাম বিবেচনায় বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্য। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত এক মাসে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ।
এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে পর্যাপ্ত চাল পাচ্ছে না সরকার। ফলে ইতিমধ্যে এক লাখ টন চাল আমদানির জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
চাল উৎপাদনকারী বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যায়ক্রমে মোট আট লাখ টন চাল আমদানি করা হবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।
তাঁর মতে, “দেশে চালের যথেষ্ট মজুত রয়েছে। সংকট হবে না। তবে এ বছর উৎপাদন কম হওয়ায় কিছু চাল কিনে রাখা হচ্ছে।”
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধরে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বছরে ৩ কোটি টনের মতো খাদ্য চাহিদার বিপরীতে দেশে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। বাকি প্রায় ৬০ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকে।
এবার চালের মজুত কমে যাওয়ায় সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বিঘ্ন ঘটছে। কিছু কর্মসূচির আওতায় চাল বিতরণ সাময়িক বন্ধ করা হয়েছে। কিছু কর্মসূচিতে চালের পরিবর্তে গম দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।
গত বুধবার জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “দেশে যাতে খাদ্যঘাটতি দেখা না দেয়, সে জন্য বিদেশ থেকে চাল কেনা হচ্ছে। হাওর অঞ্চলের চাল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে।”
ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ায় মজুত কমে গেছে বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, এ বছর সারা দেশে বোরো ধানের ব্লাস্ট রোগের প্রভাব ও হাওর অঞ্চলে ফসলহানির কারণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টন চাল কম উৎপাদিত হবে। তবে সরকারিভাবে এ ক্ষতির হিসাব ১২ লাখ টন ধরা হচ্ছে।
এ অবস্থায় চাল আমদানির সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বেনারকে বলেন, “ধানের ব্লাস্ট রোগ এবং বন্যার কারণে ধানের উৎপাদনে বিঘ্ন হওয়ায় চালের মজুত কমে গেছে।”
“এর ফলে ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহ কম থাকায় ও মূল্য ঊর্ধ্বগতি থাকার প্রেক্ষিতে বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য চাল আমদানির যৌক্তিকতা তৈরি হয়েছে। তাই আমদানির বিষয়টি ইতিবাচক,” যোগ করেন তিনি।
আমদানিই ভরসা
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি গুদামে কমপক্ষে ৬ লাখ টন চালের মজুত থাকা উচিত। তবে সরকারি সূত্র বলছে, গত মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত এই পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার টন।
এমন অবস্থায় অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ধান-চাল সংগ্রহের চেষ্টা করলেও আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ মে ভিয়েতনাম সফরে গিয়ে দেশটির সঙ্গে বছরে ১০ লাখ টন চাল আমদানির ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর (এমওইউ) করেছেন খাদ্যমন্ত্রী। আগামী ২০২২ সাল পর্যন্ত এই এমওইউ বহাল থাকবে। এ ছাড়া থাইল্যান্ড থেকেও চাল আমদানি করবে সরকার।
এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী বেনারকে বলেন, “ভিয়েতনামের সঙ্গে চাল কেনার চুক্তি হয়েছে। তবে এই অর্থবছরে কত চাল আসবে সেটা এখনো নির্ধারিত হয়নি। পর্যায়ক্রমে এসব চাল আনা হবে।”
সরকারকে চাল দিচ্ছে না দেশীয় ব্যবসায়ীরা
মৌসুমের শুরুতে এ বছর ৩৪ কেজি দরে চাল সংগ্রহ করার ঘোষণা দেয় সরকার। তবে উৎপাদন খরচের চেয়ে এ মূল্য কম হওয়ায় চালকল মালিকেরা সরকারকে চাল দিতে রাজি হচ্ছেন না।
জানা যায়, চালকলের মালিকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো, মেজর, হাসকিং ও মিল মালিক সমিতি কেজি প্রতি আরও ৪ টাকা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
দিনাজপুর চালকল মালিক সমিতির সভাপতি সারোয়ার আশফাক লিয়ন বেনারকে বলেন, “সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী আমাদের অঞ্চলে (উত্তরাঞ্চল) এসে মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে গেছেন। আমরা চাল দেওয়ার চুক্তি করেছি। এখন রমজান মাস হওয়ায় মুড়ি তৈরির চাপ বেশি। তাই জুলাই থেকে সরকারকে চাল দিতে পারব।”
“তবে সরকারও মিল মালিকদের প্রস্তাবিত দামের দিকে নজর দেবে বলে আমাদের প্রত্যাশা,” বলেন তিনি।
এদিকে দেশে চালের মজুত কমার সুযোগে বাজারে চালের দাম বেড়েছে, এর প্রভাব পড়ছে দরিদ্র মানুষের ওপর।
মে মাসের শুরুতে কেজি প্রতি মোটা চালের দাম ৪০-৪২ টাকা থাকলেও জুনের শুরুর দিতে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
খাদ্যনীতি নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) হিসাবে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে দেশের মধ্যে প্রতি কেজি চালের দর ৩৮ টাকায় উঠেছিল, বাজারে এখন তা ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা।
এর আগে ২০০৮ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রতি কেজি চাল ছিল ৩৬ টাকা। এরপর ২০১২ সালে প্রতি কেজি চাল ২৬ টাকায় নেমে আসে। ২০১৫ সালে ৩৩ টাকায় ওঠে চালের দর।
চালের বদলে গম
সরকারি সূত্র জানায়, ঈদ উপলক্ষে বিশেষ ভিজিএফ বা ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং এবং জেনারেল রিলিফ জিআর—এই দুটি সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রায় ২ লাখ টন চাল বরাদ্দ করেছিল সরকার। কিন্তু সরকারি গুদামে চালের মজুত কমে যাওয়ায় এসব কর্মসূচিতে চালের বদলে গম দেওয়ার চিন্তা করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
তবে খাদ্যমন্ত্রী বেনারকে বলেন, “সামাজিক কর্মসূচিতে চালের বদলে গম দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত হয়নি।”