রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীতে বাংলাদেশ ভবন

পরিতোষ পাল
2018.05.23
কলকাতা
পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত বাংলাদেশ ভবন পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত বাংলাদেশ ভবন। ১৪ মে ২০১৮।
সৌজন্যে শিক্ষা প্রকৌশল অধিপ্তর, ঢাকা

পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী শিক্ষাকেন্দ্রে চীনা ও নিপ্পন ভবনের পর তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ ভবন। বাংলাদেশ সম্পর্কিত চর্চা এবং গবেষণার জন্য স্থাপিত এই ভবনটি শুক্রবার (২৫ মে) যৌথভাবে উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

নরেন্দ্র মোদী পদাধিকার বলে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। তিনি একই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। সেখানে শেখ হাসিনাও উপস্থিত থাকবেন।

বিশ্বভারতী প্রাঙ্গনে রবীন্দ্রনাথের আমলেই তৈরি হয়েছিল চীনা ভবন এবং পরবর্তী সময়ে নিপ্পন (জাপান) ভবন।

বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেন বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ ভবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিশ্বভারতীর অন্য দুটি ভবনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ওই দুটি ভবনে নিয়মিত ক্লাস হয়, ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ভবনে ক্লাশের কোনও সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ভবনে বাংলাদেশের ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে নিয়মিত চর্চা এবং গবেষণা হবে।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতীয় ও অন্য বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষাবিদেরাও এখানে গবেষণা করতে পারবেন।”

গত মাসেই বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ভবনের নির্মাণ কাজ পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকদের বলেন, “দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর এক সঙ্গে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন করার বিশাল গুরুত্ব রয়েছে।”

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক পবিত্র সরকার বেনারকে বলেন, “বিশ্বভারতীতে বিদেশি রাষ্ট্রের ভবনের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। বিশ্বভারতীর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই গভীর। এখানে বাংলাদেশের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করতে আসে। রবীন্দ্রনাথও তাঁর জীবনের একটি বড় অংশ কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। তাই বিশ্বভারতীতে বাংলাদেশ নিয়ে চর্চা ও গবেষণার জন্য আলাদা ভবন নির্মাণ খুবই আনন্দের বিষয়।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে। সেই সূত্রে বাংলাদেশ ভবন বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সঙ্গীত নিয়ে চর্চা ও গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখবে।”

নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমানে এটি একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ ভবন কীভাবে হলো

২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন তৈরির প্রস্তাব দেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাতে রাজি হন।

২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ পূর্বপল্লীতে ইন্দিরা গান্ধী সেন্টারের কাছে জমি চিহ্নিত করে।

২০১৫ সালে প্রস্তাবিত বাংলাদেশ ভবনের বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত নকশাটি বিশ্বভারতীর হাতে তুলে দেওয়া হয়।

“বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া নকশা অনুযায়ীই ভবন নির্মাণের কাজ হয়,” বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী কল্লোল দত্ত মন্ডল।

তিনি বলেন, “দ্বিতল এই ভবনটির প্রবেশ পথের দুধারে থাকছে বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথের দুটি ম্যুরাল।”

“নির্মাণ কাজটি করেছে ভারত সরকারের এনবিসিসি (ইন্ডিয়া) লিমিটেড,” বলেন সংস্থার প্রজেক্ট এক্সিকিউটিভ (সিভিল) চন্দন সেন।

বাংলাদেশ সরকার এই ভবন নির্মাণে পুরো অর্থায়ণ করেছে বলে জানা গেছে, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৫ কোটি টাকা।

ভবনে কী কী থাকছে

“বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের নামে একটি ভবন তৈরি হওয়ায় আমরা গর্ব অনুভব করছি। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাধারণ মানুষ আরও বেশি করে জানতে পারবে বাংলাদেশের কথা, বাংলাদেশের ইতিহাস,” বেনারকে বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি গবেষক আবদুল্লা আল মামুন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক বাংলাদেশি ছাত্র অর্ণব সান্যাল বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধনে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি নিয়ে আমরা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা রীতিমত এক্সাইটেড হয়ে আছি।”

“প্রায় দুই বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা এই দ্বিতল ভবনটিতে একটি আন্তর্জাতিক মানের অডিটোরিয়াম, একটি সেমিনার হল, একটি মিউজিয়াম, একটি গ্রন্থাগার, ফ্যাকাল্টি কক্ষ, গবেষণা কক্ষ ও একটি কাফেটারিয়া থাকছে,” বলে বেনারকে জানান বিশ্বভারতীর প্রকৌশলী কল্লোল দত্ত মন্ডল।

তিনি বলেন, “প্রবীণদের কথা মাথায় রেখে একটি লিফট রাখা হয়েছে। আগামী দিনে ভবনের পিছনের দিকে একটি ওপেন এয়ার গ্যালারি তৈরি করা হবে। আরও তৈরি করা হবে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে একটি শহীদ মিনার।”

বাংলাদেশ উপ দূতাবাস সূত্রে বলা হয়, মিউজিয়ামে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি ও ঐতিহাসিক নানা তথ্য থাকছে। থাকছে রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশে অবস্থানের নানা তথ্য, ইতিহাস, স্মারক এবং চিত্রকর্ম। আর লাইব্রেরিতে থাকছে বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য, সংস্কৃতির পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে নিয়ে গবেষণা ও মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান নিয়ে ছয় হাজারের বেশি বইপত্র।

হাসিনাকে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সম্মান

পশ্চিমবঙ্গের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষ সম্মান জানাচ্ছে। আগামী ২৬ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে আচার্য কেশরীনাথ ত্রিপাঠি ও প্রধান অতিথি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে তাঁকে ডি লিট উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাধন চক্রবর্তী সাংবাদিকদের বলেন, “শোষণহীন, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার যে স্বপ্ন নজরুলের ছিল, তা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান অবিস্মরণীয়। এটা দেখেই আমরা তাঁকে সম্মান জানাচ্ছি।”

“একই সঙ্গে এই সম্মাননা আমাদের মধ্যেকার সেতুবন্ধনকেও আরও দৃঢ় করবে,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশ ভবনের নির্মাণকাজ ও উদ্বোধনের প্রস্তুতি দেখতে ঢাকা থেকে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীসহ একটি দল এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শান্তিনিকেতন সফর করেন। ঢাকায় ফিরে প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মদ হানজালা বেনারকে বলেন, দৃষ্টিননন্দন এই ভবনটি উদ্বোধনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত করা হয়েছে। ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের সঙ্গে পরামর্শ করে চমৎ​কার একটি ভবন করেছেন যা দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার করতে সহায়তা করবে।

ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।