রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: মোদির উপস্থিতিতে ভারতের সহায়তা চাইলেন হাসিনা
2018.05.25
কলকাতা

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে ভারতের সহযোগিতা চাইলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে নবনির্মিত বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন।
তিনি বলেন, “আমরা মানবিক কারণে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি। তাঁরা দ্রুত মিয়ানমারে ফিরে যাক, সেটাই চাই।”
একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর বক্তৃতায় রোহিঙ্গা বিষয়ে অবশ্য কোনও বক্তব্য দেননি।
তবে মোদীর উপস্থিতিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হোক, যাতে মিয়ানমার সরকার তাঁদের ফেরত নেয়।”
গতকাল হাসিনা–মোদীর ৪৫ মিনিটের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা, তা দুই দেশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়নি। তবে ঢাকা ও পশ্চিমবঙ্গের বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, দুই প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা করবেন—এটা অনেকটাই নিশ্চিত।
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শিবাজীপ্রতীম বসু মনে করেন, “বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ভারতের সাহায্য আগেও চেয়েছেন, এখনও চাচ্ছেন। তবে তাতে লাভ কিছু হবে বলে মনে হয় না।”
তিনি বেনারকে বলেন, “ভারত প্রথম থেকেই মিয়ানমারের প্রতি নরম মনোভাব দেখিয়ে চলছে। মিয়ানমারে যাতে চীনের প্রভাব বাড়তে না পারে সেজন্যই ভারত এই নীতি নিয়ে চলেছে বলে ধারণা করা যায়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতসহ বিশ্বকে পাশে থাকার যে আহ্বান জানিয়েছেন তা কূটনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো দ্বিপাক্ষিক বৈঠক বা সফরে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানাচ্ছেন। এর ইতিবাচক দিক হলো, তিনি যেখানেই যাচ্ছেন ইস্যুটি তুলছেন এবং রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি আলোচনার মধ্যে রাখতে চাইছেন।”
বাংলাদেশের ওই অধ্যাপকের মতে, “মিয়ানমারে বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করে কোনোকিছু আদায় ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়; কারণে এখানে রাশিয়া ও চীন ছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা বিষয় যুক্ত আছে।”
“তবে ভারত এখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখতে চাচ্ছে, আগে এটুকু ছিল না,” বলেন দেলোয়ার হোসেন।
বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনের সময় নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করেন। তিনি সমাবর্তন ভাষণে বলেন, “ভারত ও বাংলাদেশ দুটি আলাদা দেশ হলেও পারষ্পরিক সহযোগিতা এই দুই দেশকে জুড়ে দিয়েছে।”
তিনি বলেন, “ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের পরিপূরক।”
এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা স্মরণ করে বলেন, “দুই প্রতিবেশি দেশকে এক হয়ে চলতে হবে। তাহলে, দুই দেশের সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও দৃঢ় হবে।”
অ্যামনেস্টির বিবৃতি
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল ইন্ডিয়ার পক্ষে গতকাল এক বিবৃতিতে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ও ভারতের কাছে তাঁদের নিজ নিজ দেশে সুনির্দিষ্ট মানবিক অধিকার নিয়ে উদ্বেগ নিরসনের দাবি জানানো হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল ইন্ডিয়ার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আকর প্যাটেল বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেখানে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য সেদেশের দরজা খুলে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সেখানে ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে থাকতে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের অনিচ্ছুক মনোভাব হতাশাজনক।
প্যাটেল বলেন, নির্যাতন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাত থেকে যারা পালিয়ে এসেছে তাঁদের রক্ষা করতে ভারতের উচিত উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা
সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব ইহসানুল করিমকে উদ্ধৃত করে জানায়, দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয় স্থান পায়। তবে এসব বিষয় সুস্পষ্টভাবে প্রেস সচিব উল্লেখ করেননি।
অধ্যাপক বসু বলেন, “এদিন দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যেসব আলোচনা হয়েছে তাতে তিস্তাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়াটা স্বাভাবিক।”
এই বৈঠকে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা উপস্থিত ছিলেন না। তবে তিনি বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন।
হাসিনার সঙ্গে মমতার বৈঠক
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শনিবার বৈঠক করবেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শান্তিনিকেতনে তিনি নিজেই সাংবাদিকদের একথা বলেন। তবে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কোনও কথা হবে না বলেও জানান তিনি।
অধ্যাপক রণজয় সিনহা বেনারকে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তির কারণেই তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি আটকে রয়েছে। মমতা মনে করেন, তিস্তা হল উত্তর বঙ্গের জীবন রেখা।”
দুই দিনের পশ্চিমবঙ্গ সফরে শুক্রবার সকালে শেখ হাসিনা শান্তিনিকেতনে আসেন। শনিবার তিনি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মাণসূচক ‘ডি লিট’ ডিগ্রি গ্রহণ করবেন।
ঢাকার রাজনীতিতে তিস্তা বিতর্ক
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতকে বাংলাদেশের পাশে না পাওয়ার সমালোচনা ছাড়াও দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ভারত সফরে তিস্তা চুক্তি না হলেও অগ্রগতি হবে বলে মন্তব্য করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, “বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি ভালো। চুক্তি যেকোনো সময় হতে পারে।”
শুক্রবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যানজট নিরসনে করণীয় বিষয়ক সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক কাদের বলেন, “এই সফরে তিস্তা চুক্তি না হলেও অগ্রগতি হবে।”
এদিকে সাবেক আইনমন্ত্রী এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মওদুদ আহমদ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বলেন, “আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রী তিস্তা পানি বণ্টনের চুক্তি করে দেশে ফিরবেন। যদি না আসেন, তাহলে মনে করব যে তাঁর ভারত সফর ব্যর্থ হয়েছে।”
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।