বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ ও ভারতের নৌবাহিনীর প্রথম যৌথ টহল শুরু

পুলক ঘটক
2018.06.27
ঢাকা
180627_BD-India_Navy_1000.jpg ভারতীয় নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল সুনীল লানবা ও বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ ডিজিটাল গ্লোব স্পর্শের মাধ্যমে দুই দেশের যৌথ টহল কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। ২৭ জুন ২০১৮।
সৌজন্যে: আইএসপিআর

বাংলাদেশ ও ভারতের নৌবাহিনী প্রথমবারের মতো বঙ্গোপসাগরে যৌথ টহল শুরু করতে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের জলসীমা থেকে এই টহল শুরু হবে। ৩ জুলাই শেষ হবে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের বিশাখাপত্তমে।

বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ ও ভারতীয় নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল সুনীল লানবা বুধবার চট্টগ্রামে কোঅর্ডিনেটেড পেট্রল বা করপাট হিসেবে পরিচিত এই টহলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

“সমুদ্র এলাকায় অবৈধভাবে মৎস্য আহরণ, চোরাচালান, মানবপাচার, জলদস্যুতা ও সন্ত্রাসবাদ এবং মাদক পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিরসনের লক্ষ্যে এই যৌথ টহল পরিচালিত হবে,” জানিয়েছে বাংলাদেশের আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।

এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বেনারকে বলেন, “এ ধরনের এক্সারসাইজ ভালো। এগুলো ঐতিহ্যগতভাবে হয়ে থাকে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে আমরা মহড়া করেছি। ভারতের সঙ্গে এর আগেও মহড়া হয়েছে। তবে অপারেশনাল মহড়া এই প্রথম। দুই দেশের সম্পর্ক ও আস্থা বৃদ্ধিতে এগুলো ভালো ভূমিকা রাখে।”

সীমান্তের বড় সমস্যা চোরাচালান ও মাদক

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে চোরাচালান বড় ধরনের সমস্যা এবং এটা ক্রমেই বেড়েছে। এর সাথে বেড়েছে সোনা, অস্ত্র, মাদক ও নারী পাচার। গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানেই এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির অভিযানে ২০১৭ সালে ১ হাজার ২১৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকার চোরাচালান ও মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়। এর আগের বছর (২০১৬ সালে) বিজিবি’র অভিযানে ১ হাজার ১৬১ কোটি ৬৭ লক্ষ ১৭ হাজার মূল্যের বিভিন্ন প্রকারের চোরাচালান ও মাদক দ্রব্য আটক করা হয়েছিল।

ইন্টারন্যাশনাল নারকটিকস কন্ট্রোল বোর্ডের বার্ষিক প্রতিবেদন-২০০৭ এ বলা হয় মিয়ানমারসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশে থেকে মাদক পাচারের রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

মাদকদ্রব্য ও চোরাচালান পণ্যের আটক বা জব্দ হওয়ার এই চিত্র প্রমাণ করে সীমান্তে চোরাচালান বেড়ে গেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশের ৪ হাজার ৭০০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার ফাঁকফোকর গলেই পাশের দেশ থেকে এ দেশে চোরাচালান পণ্য ঢুকছে। দেশের অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

তাঁদের মতে, এই পরিসংখ্যান বিজিবির হলেও বাস্তব ঘটনা কয়েকগুণ বেশি বলে সীমান্ত এলাকাগুলোর একাধিক সূত্রের দাবি। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন ও প্রতিরক্ষা সহায়তার ক্ষেত্রে যৌথ টহলের এই উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার হবে

যৌথ টহল এবং অ্যাডমিরাল সুনীল লানবা’র বাংলাদেশ ভ্রমণ প্রসঙ্গে ভারতীয় নৌবাহিনীর বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরালো হবে এবং দু’দেশের নৌবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতার নতুন পথের সন্ধান মিলবে।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ৯ এপ্রিল দিল্লি ভ্রমণকালে দু’দেশের মধ্যে একটি সামরিক সহায়তা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর আওতায় দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে এই যৌথ টহল অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।

উল্লেখ্য, গত বছর মার্চে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে দুটি সাবমেরিন যুক্ত হওয়ার পর তা ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনীতে পরিণত হয়।

যৌথ টহল উদ্বোধন

বুধবার চট্টগ্রামে বানৌজা ঈসা খানের এসএমডব্লিউটি মিলনায়তনে যৌথ টহলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ ও ভারতীয় নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল সুনীল লানবা।

যৌথ এ টহলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধজাহাজ ‘বানৌজা আবু বকর’ ও ‘বানৌজা ধলেশ্বরী’ এবং এমপিএ (মেরিটাইম পেট্রল এয়ারক্রাফট) এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘আইএনএস সাতপুরা’ ও ‘আইএনএস খেদমত’ এবং এমপিএ অংশগ্রহণ করবে।

যুদ্ধজাহাজ ও এয়ারক্রাফটগুলো বাংলাদেশের জলসীমা থেকে যৌথ টহল শুরু করে বঙ্গোপসাগরে ভারতের সমুদ্রসীমার দিকে অগ্রসর হয়ে অন্ধ্র প্রদেশের বিশাখাপত্তমে পৌঁছাবে।

বঙ্গোপসাগরে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ ধরনের যৌথ টহলের ভূমিকা উল্লেখ করে অনুষ্ঠানে অ্যাডমিরাল নিজাম উদ্দিন বলেন, “বিশাল সমুদ্র এলাকায় এককভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি চ্যালেঞ্জের বিষয়। এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা, এ সংক্রান্ত তথ্যাদির আদান-প্রদান এবং সমন্বিত নজরদারি সমুদ্র এলাকার নিরাপত্তাকে জোরদার করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

ভারতীয় নৌবাহিনী প্রধান বলেন, “ভারত সব সময়ই বাংলাদেশের সাথে সহ-অবস্থানে থেকে বিশাল সমুদ্র এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সন্ত্রাসবাদ দমন, যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলা, সমুদ্র সম্পদ রক্ষাসহ ব্লু ইকনোমির উন্নয়নে একসাথে কাজ করে যেতে আগ্রহী।”

“এই পদক্ষেপ আঞ্চলিক সমুদ্র নিরাপত্তা রক্ষা, সমুদ্র নিরাপত্তার ঝুঁকি মোকাবিলা ও সমুদ্র অর্থনীতির উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে,” আইএসপিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছে।

যৌথ টহলের গুরুত্ব তুলে ধরে সামরিক সম্পর্ক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুর রশিদ বেনারকে বলেন, “এই ধরনের মহড়া আন্তদেশীয় উত্তেজনা প্রশমিত করে, পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ এবং সহায়তার ক্ষেত্র তৈরি করে এবং দক্ষতা বাড়ায়।”

তবে “দ্বিপক্ষীয় সামরিক জোটের বিষয় এতে নেই,” মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকায় সুনীল লানবা

যৌথ টহলের উদ্বোধন করতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধানের আমন্ত্রণে মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছেন ভারতের নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল সুনীল লানবা। বাংলাদেশে তিনি ছয় দিন অবস্থান করবেন।

ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি বাংলাদেশের তিন বাহিনী প্রধান এবং উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এ ছাড়া তিনি রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হবেন।

বৈঠকে দু’দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।