জামিলুর রেজা চৌধুরী: বহুমুখী প্রতিভার বিদায়ে শোকে মুহ্যমান বাঙালি
2020.04.28
ঢাকা
একজন মানুষ কর্মজীবনে কতরকম ভূমিকা রাখতে পারেন, তার প্রমাণ দিয়ে গেলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। শিক্ষা, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, রাজনীতি—সর্বত্রই ছিল তাঁর বিচরণ। মঙ্গলবার ভোরে ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন বিশিষ্ট এই নাগরিক।
তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান তাঁর ছাত্রছাত্রী, স্বজন–সহকর্মীসহ দেশের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
“খ্যাতিমান প্রকৌশলী হিসেবে ড. জামিলুর রেজা দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন,” শোকবার্তায় বলেন প্রধানমন্ত্রী।
বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের নেতৃত্বদানকারী এই গুণী ব্যক্তিত্বের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের সবগুলো বড় স্থাপনার সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে যুক্ত ছিলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী।
“আমি বলব বাংলাদেশে প্রকৌশল খাতে এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। জ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান রেখে বলতে চাই, সবাইকে নিয়ে কাজ করার যে ক্ষমতা স্যারের ছিল, সেটা দুর্লভ। সবার কথা তিনি শুনতেন, সবাইকে আস্থায় নিয়ে কাজ করতেন,” বেনারকে বলেন মেহেদী আহমেদ আনসারী, যিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক। তিনি একাধারে অধ্যাপক চৌধুরীর ছাত্র ও সহকর্মী ছিলেন।
বিশিষ্ট এই প্রকৌশলী বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সের সভাপতি ছিলেন নব্বই দশকের শুরুতে। আর্থকোয়েক সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। তিনি ছিলেন বোর্ড অফ অ্যাক্রিডিটেশন ফর ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনিক্যাল এডুকেশন, বাংলাদেশের চেয়ারম্যান।
১৯৬৩ সালে বুয়েটে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। এরপর ব্রিটেনে উচ্চশিক্ষা শেষে আবার বুয়েটে ফিরে আসেন। ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। পিএইচডি করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ সাউদাম্পটন থেকে, বিষয় ছিল বহুতল ভবন।
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ঢাকায় শিল্পব্যাংক ভবনের ডিজাইনে প্রথম যুক্ত হন তিনি।
জামিলুর রেজা চৌধুরী বুয়েটের চাকরি ছেড়ে যোগ দেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে, তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য। সবশেষ যুক্ত ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য হিসেবে।
ড. তাসনিয়া হুসাইন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তিনি বেনারকে বলেন, “অত্যন্ত জ্ঞানী ও সজ্জন মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ। সব সময় আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন নতুন কিছু করতে।”
বর্ণাঢ্য জীবন বলতে যা বোঝায়, তার প্রতিকৃতি ছিলেন জামিলুর রেজা। তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে। ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক সংকটের সময় বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে যোগ দেন তিনি।
অধ্যাপক চৌধুরীর জন্ম সিলেটে ১৯৪৩ সালে। পড়ালেখা করেছেন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল ও ঢাকা কলেজে। ১৯৬৩ সালে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বর্তমানে বুয়েট) থেকে বিএসসি ও এমএসসি পাস করেন।
পড়ালেখা শেষে ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৭৬ সালে বুয়েটে অধ্যাপক হন। তিনি একাধারে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ছিলেন, অনুষদে ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে অসংখ্য লেখা রয়েছে তাঁর।
তথ্য প্রযুক্তিবিদ হিসেবে অবদান রাখা ছাড়াও গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর ভূমিকা ছিল। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি।
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সমন্বয়ক বায়েজীদ ভূঁইয়া জুয়েল বেনারকে বলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কিশোরদের সঙ্গে থেকে তাদের জন্য কাজ করে গেছেন।
“স্যার কিশোরদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। একটা বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম গড়ে উঠুক—এই ছিল তাঁর চাওয়া,” বায়েজীদ ভূঁইয়া বেনারকে বলেন।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে বিশিষ্ট এই নাগরিককে নিয়ে ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠান, শোকসভা বা স্মরণসভা হয়নি। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর স্বজন জিয়া ওয়াদুদ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ যেন জানাজায় শরিক না হন।
তারপরও ধানমন্ডির একটি মসজিদে সামাজিক দূরত্ব মেনে অনেকেই যোগ দেন কৃতী এই মানুষের জানাজায়।
অধ্যাপক চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর শুভানুধ্যায়ীদের অনেকেই ফেসবুকে তাঁর ছবি দিয়েছেন নিজের প্রোফাইল ফটো হিসেবে, নানাভাবে তাঁর স্মৃতিচারণ করছেন।
সাবেক সচিব নজরুল ইসলাম খান নিজের ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “আমাদের শ্রেষ্ঠ বাঙালিগুলো একে একে হারিয়ে গেল। প্রকৌশল জগতে ন্যায়ের মশাল কে জ্বালাবে?”