কেরানিগঞ্জে গ্রেপ্তার ২৭ তরুণের বিরুদ্ধে সমকামিতার প্রমাণ মেলেনি
2017.06.09
ঢাকা

গত মাসে ঢাকার কেরানিগঞ্জে একটি কমিউনিটি সেন্টার থেকে গ্রেপ্তারের পর ২৭ তরুণকে মিডিয়ায় সমকামী হিসেবে উপস্থাপন করলেও তাঁদের বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এদিকে মাদক দ্রব্য আইনে মামলা দেওয়ায় এখনো মুক্তি না পাওয়া এইসব তরুণদের সমকামী হিসেবে প্রচার করায় সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তাঁরা। তবে তাঁদের সমকামী হিসেবে প্রচারের জন্য এখন মিডিয়াকেই দুষছে পুলিশ।
“আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ পায়নি। মিডিয়াই এসব প্রচার করেছে,” বেনারকে বলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মেহেদী হাসান।
গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে অবৈধ মাদক দ্রব্য সঙ্গে রাখার দায়ে শিগগিরই অভিযোগপত্র দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
“আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে সন্দেহে তাদের আটক করেছে সেটাই বলবে। সমকামিতার কথা আনবে কেন? তাদের সামাজিকভাবে অপদস্ত করার জন্য এটা করা হয়েছে। এটা অন্যায়,” বেনারকে বলেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
তিনি বলেন, “এই ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতদের সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
“আইনের ভাষায় এটা ক্রিমিনাল ইন্টিমিডেশন, যা ফৌজদারী অপরাধ,” বলেন ব্যারিস্টার বড়ুয়া।
উল্লেখ্য, গত ১৮ মে শেষ রাতে ঢাকার কেরানিগঞ্জের ছায়ানীড় কমিউনিটি সেন্টারে অভিযান চালিয়ে ২৭ তরুণ ও কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপককে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। পরদিন ২৭ তরুণকে সমকামী হিসেবে মিডিয়ার সামনে দাঁড় করানো হয়।
“যুবকেরা প্রতি দুই মাস অন্তর চাঁদা তুলে এ কমিউনিটি সেন্টারটি ভাড়া নেয়। তারা সমকামিতার উদ্দেশে জড়ো হতেন বলে স্থানীয়দের কাছে অভিযোগ পেয়ে সেখানে অভিযান চালানো হয়,” ১৯ মে মিডিয়ার সামনে বলেছিলেন র্যাব-১০ এর অধিনায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর।
ফেসবুক ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে তাঁরা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ওই কমিউনিটি সেন্টারে একত্র হয়েছিল বলেও র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
তবে পরবর্তীতে তাঁদের বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ আনা হয়নি। মাদক সেবন এবং মাদকদ্রব্য সঙ্গে রাখার অভিযোগের মামলা দিয়ে তাঁদের কেরানিগঞ্জ থানায় সোপর্দ করে র্যাব।
গ্রেপ্তার ২৮ জনের মধ্যে গত সপ্তাহে কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপক জামিন পেয়েছেন। বাকি ২৭ জনের জামিন হয়নি বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মেহেদী হাসান।
র্যাবের ভাষ্য
সমকামিতার প্রমাণ না পাওয়া সম্পর্কে পুলিশের বক্তব্যের ব্যাপারে মতামত জানতে চাওয়া হলে র্যাব-১০ এর অধিনায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বুধবার বেনারকে বলেন, “সমকামিতার ব্যাপারে এলাকাবাসীর অভিযোগের ভিত্তিতেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তরুণেরাও র্যাবের কাছে সমকামিতার কথা স্বীকার করেছিল।”
“তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কারণ দেশের আইন অনুযায়ী সমকামিতা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ,” বলেন তিনি।
তাঁদের বিরুদ্ধে মাদকের মামলা দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “সেই রাতে সমকামিতায় লিপ্ত না হওয়ার কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনা হয়নি। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়েছে।”
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের আইনে সমকামিতা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় সমকামিতার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজাও হতে পারে। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে সমকামিতার বিরুদ্ধে এ আইন প্রণয়ন করা হয়। এখন পর্যন্ত আইনটিতে কোনো সংশোধন আনা হয়নি।
কী পাওয়া গিয়েছিল?
গ্রেপ্তারের পর ওই র্যাব কর্মকর্তা বলেছিলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে অবৈধ মাদকদ্রব্য, কনডম ও লুব্রিকেটিং জেল উদ্ধার করা হয়েছে। তবে কী ধরনের মাদক উদ্ধার করা হয়েছে তা তিনি তা নির্দিষ্ট করে বলেননি। পরে জব্দ তালিকায় ২৫০ গ্রাম গাঁজা, ৩৪ টি ইয়াবা কিছু কন্ডম ও জেল উদ্ধারের কথা বলা হয়।
তবে কমিউনিটি সেন্টারের হিসাব রক্ষক সাখাওয়াত বেনারকে বলেন, “র্যাব তাঁদের কাছ থেকে কয়েকটা মোবাইল ফোন এবং কয়েক বোতল বিয়ার উদ্ধার করেছিল।”
সাখাওয়াত জানান, ওই যুবকরা গায়েহলুদ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। তাঁরা যে সমকামী এটা তাঁর মনে হয়নি।
সংকট পরিবারে ও সমাজে
এদিকে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির জন্য তাঁদের পরিবারের পক্ষ থেকে তেমন কেউ যোগাযোগও করছেন না বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা।
মেহেদী হাসান বলেন, “এসব যুবকের পিতামাতা তাঁদের প্রতি ক্ষুব্ধ। তাঁরা লজ্জায় আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না।”
যোগাযোগ করা হলে গ্রেপ্তার হওয়া সরকারি বাঙলা কলেজের ছাত্র আবেদুর রহমানের বড় ভাই সাদেকুর রহমান বেনারকে বলেন, “গত ১৮ মে বন্ধুদের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা বলে আবেদুর বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিল।”
“পরে শুনেছি সমকামিতার দায়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না আমার ভাই সমকামী। সে মাদকদ্রব্যের প্রতিও আসক্ত নয়,” তিনি বলেন।
সাদেকুর বলেন, “আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ আনায় আমরা সামাজিকভাবে হেয় হয়েছি।”
গ্রেপ্তার হওয়া সাহাদতের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে ফোন ধরেন তাঁর চাচাতো ভাই রাসেল। তবে তিনি সাহাদতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বীকার করতে চাননি।
বেনারকে তিনি বলেন, “আমি সাহাদত নামের কাউকে চিনি না। এই সিমটা আমার নয়। তবে আমি এটা আপাতত ব্যবহার করছি।”
তরুণদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবি
দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মোর্চা হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ ২৭ তরুণের সাংবিধানিক ও আইনগত অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।
গত ২১ মে এক যৌথ বিবৃতিতে এসব সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, আটকের পর তাঁদের সমকামী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং ছবি প্রকাশ করায় তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগে এভাবে তরুণদের সমকামী হিসেবে চিহ্নিত করায় তাদের মানবিক মর্যাদা হুমকিতে পড়েছে।
ফোরামের আহ্বায়ক শীপা হাফিজা বিবৃতিতে সই করেন।