সমকামী সন্দেহে গ্রেপ্তার ২৭, চাপের মুখে যৌন সংখ্যালঘুরা
2017.05.19
ঢাকা

ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানার আঁটিবাজার এলাকা থেকে ২৭ জন তরুণকে সমকামী সন্দেহে আটক করেছে র্যাব। যদিও গ্রেপ্তারকৃতদের কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, একটি ডিজে পার্টিতে যোগ দিতে তাঁরা সেখানে জড়ো হয়েছিলেন।
এসব তরুণ সমকামী কিনা—তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বাংলাদেশে যৌন সংখ্যালঘুরা চাপের মুখে আছেন।
বাংলাদেশের আইনে সমকামিতা একটি অপরাধ। দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় সমকামিতার দায়ে অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে যাবজ্জীবন অথবা নির্দিষ্ট মেয়াদে দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান আছে।
ঊনিশ শতকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা এই আইনের প্রবর্তক। ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল এমন বেশ কিছু দেশে এখনো এই আইন বলবৎ আছে।
২০০৯ সালে জাতিসংঘ, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনায় ৩৭৭ ধারা বাতিল এবং সমকামীদের মানবাধিকার সমুন্নত রাখার দাবি করেছিল। তার প্রেক্ষিতে সরকার দেশে সমকামীদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে। একই ইস্যুতে ২০১৩ সালে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয় জাতিসংঘে।
সমকামীদের নতুন ব্লগ ধী
জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ডের প্রথম বার্ষিকীতে বয়েজ অব বাংলাদেশ ধী নামের একটি ব্লগ চালু করেছে। নিহত দুজন সমকামীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, সমকামীদের দুর্দশা এবং তাদের অধিকার নিয়ে লেখা থাকছে এই ব্লগটিতে। বাংলাদেশ ও বিদেশে থাকা স্বঘোষিত সমকামীদের সংগঠন এই বয়েজ অব বাংলাদেশ।
ধী ব্লগের ওয়েবপেজে তাঁরা বলেন, “বাংলাদেশের সমকামীদের আন্দোলনের বর্তমান ঘোলাটে পরিস্থিতির এক টুকরো ছবির দেখা মিলবে এ কমিউনিটি ব্লগে। আমরা আশা করি আদর্শের আলোয় খুব শিগগিরই কেটে যাবে ঘৃণার অন্ধকার।”
এ বছরের ৩০ মার্চ জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে ১৪টি ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ সরকারকে। এতে দুজন সমকামী যদি পারস্পরিক সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য না করার সুপারিশ করা হয়।
যৌন সংখ্যালঘুদের কণ্ঠরোধ
গত বছরের ২৫ এপ্রিল পান্থপথের বাসায় ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয় খুন হন। হত্যাকাণ্ডের পর আনসার আল ইসলাম এর দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়। এক বছর পরও ওই ঘটনায় সরাসরি যুক্ত ছিল এমন একজনকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। নিরাপত্তাহীনতার কারণে নিহতদের পরিবারও এ বিষয় নিয়ে সেভাবে সরব হয়নি।
এ প্রতিবেদনটি লেখার সময় সমকামী অধিকার নিয়ে কাজ করেন বা সমকামী এমন একজন ব্যক্তিও নাম প্রকাশ করতে চাননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান তানিয়া হক বলছিলেন, বিষয়টি নিয়ে সমকামীরা কথা বলছেন না। অন্যরাও চুপ করে আছেন। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় যখন এ বিষয়গুলো আসে তখন অনেকে অস্বস্তি বোধ করেন।
‘যৌন সংখ্যালঘু (লেসবিয়ান, গে, বাই সেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার-এলজিবিটি) রা প্রাচীনকাল থেকে আমাদের সমাজে আছেন। কিন্তু আমরা তাঁদের ব্যাপারে আলোচনা করছি না। ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে এখন কথাবার্তা হচ্ছে। এর পরের স্তরে আমরা কবে পৌঁছাব বলা যাচ্ছে না। সমাজে বৈচিত্র্য আছে। বৈচিত্র নিয়ে গবেষণা হওয়াই সমীচীন।’
ওই শিক্ষকের মতে, সমকামিতা কেন, এর পেছনে যেসব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে সেগুলো কোনো না কোনোভাবে প্রচার করতে হবে। মানুষ জানে না বলেই সহজে ব্যতিক্রমী কিছু গ্রহণ করতে পারে না।
মানুষকে জানানোর কোনো উদ্যোগ বয়েজ অব বাংলাদেশ নেবে কি না জানতে বয়েজ অব বাংলাদেশের একজন শীর্ষ অধিকারকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলছিলেন, তাঁরা এই মুহূর্তে মারাত্মক ভীতির মধ্যে আছেন। যে রাতে জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয় খুন হন, সে রাতের স্মৃতিচারণ করে তিনি ইমেইলে একটি লেখা পাঠান। তাঁর দুই বন্ধু খুন হওয়ার আগে তিনি যে মুঠোফোন নম্বরটি ব্যবহার করতেন, সেই পুরনো নম্বরটিও বদলে ফেলেছেন।
‘সে রাতে আমি ঘুমোতে পারিনি। …মনে হচ্ছিল কেউ হয়তো চাপাতি নিয়ে কোপাতে আসছে,” বলছিলেন জুলহাজ ও মাহবুবের বন্ধু।
খুব শিগগির এলজিবিটি নিয়ে কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছেন কি না এমন প্রশ্নে যৌন সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁরা মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
“বছর দুয়েক আগেও আমরা কিছু কিছু গোলটেবিল বৈঠক, কিছু সেমিনার, কর্মশালা করেছি। ফেলোশিপ নিয়ে সাংবাদিকেরা কাজ করেছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা ঠিক ভরসা পাচ্ছি না। আমরা আমাদের মতো করে ভেতরে ভেতরে কাজ করছি,” ওই ব্যক্তি বলেন।
সমকামী সন্দেহে ২৭ জন আটক
ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানাধীন আঁটিবাজার এলাকা থেকে ২৭ জন তরুণকে সমকামী সন্দেহে আটক করেছে র্যাব। এ ছাড়া এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ছায়ানীড় কমিউনিটি সেন্টারের তত্ত্বাবধায়ক মো. জসিমউদ্দিন (৫৫) কে আটক করেছে।
র্যাব জানিয়েছে, তাঁদের কাছ থেকে গাঁজা, ইয়াবা, নেশাজাতীয় দ্রব্য, যৌন উত্তেজক সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে। আটকৃতদের বয়স ১৮-২০ এর কাছাকাছি। বেশির ভাগই ছাত্র।
র্যাব-১০ এর কেরানীগঞ্জ ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মঞ্জুর মোরশেদ বেনারকে বলেন, “গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে র্যাব সদস্যরা ছায়ানীড় কমিউনিটি সেন্টারে অভিযান চালায়। সমকামিতা চেষ্টার অভিযোগে সেখান থেকে ২৭ জন সমকামী এবং কমিউনিটি সেন্টারের তত্ত্বাবধায়ককে আটক করা হয়।”
“ঢাকা থেকে আমার এক বন্ধু আমাকে মুঠোফোনে ডিজে পার্টির দাওয়াত দেয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বন্ধুর সঙ্গে কেরানীগঞ্জে আসি। পার্টিতে শুধু ঢাকার বন্ধুরাই নয় ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শতাধিক বন্ধু অংশ নেয়,” বেনারকে জানান আটক হওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্র।
“আমরা নাচের অনুষ্ঠান শেষ করে সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া করতে ছিলাম। সেই মুহূর্তে র্যাব সদস্যরা আমাদের আটক করে,” জানান ওই ছাত্র।
র্যাব ১০ এর কমান্ডিং অফিসার জাহাঙ্গীর মাতুব্বর বেনারকে জানান, আটক তরুণদের বিরুদ্ধে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।