সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার অর্থায়ন বিষয়ে মালয়েশিয়ার কাছে তথ্য চায় ভারত
2020.12.15
কুয়ালালামপুর

ভারতে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলায় ব্যবহারের জন্য কুয়ালালামপুর থেকে দুই লাখ ডলার অর্থ পাঠানোর বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন দেশটির একজন শীর্ষস্থানীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা।
সম্প্রতি ভারতের শীর্ষস্থানীয় দুটি সংবাদপত্র দেশটির গোয়েন্দা নথি দেখার দাবি করে জানায়, ওই নথি অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত ভারতীয় ইসলামিক বক্তা জাকির নায়েক ও মোহাম্মাদ নাসির নামে এক রোহিঙ্গা নেতা উত্তর-পূর্ব ভারতে সন্ত্রাসী হামলা চালাতে নারী নেতৃত্বাধীন একটি দলকে ওই অর্থ দিয়েছেন।
“এ খবরটি যেদিন ছাপা হয় সেদিনই আরো কিছু তথ্যের জন্য তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে,” গত সপ্তার শেষ দিকে ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত খবর প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মালয়েশিয়া নিরাপত্তা কর্মকর্তা। বিষয়টি স্পর্শকাতর বিবেচনায় তিনি তাঁর নাম প্রকাশ করতে চাননি।
তিনি বলেন, “বিষয়টা নিয়ে একটু ধোঁয়াশা আছে। কারণ, যেহেতু তারা তদন্ত করছে, তাদেরই উচিত ছিল আরেকটু বিস্তারিত তথ্য দেওয়া।”
এবিষয়ে বেনারের পক্ষ থেকে নয়া দিল্লির সন্ত্রাসদমন ও পশ্চিমবঙ্গের অপরাধ তদন্ত বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। কুয়ালালামপুরে ভারতীয় দূতাবাসও কোনো তাৎক্ষণিক মন্তব্য করতে চায়নি।
ভারতীয় সংবাদগুলোতে বলা হয়, নয়া দিল্লির কাছাকাছি নারী নেতৃত্বাধীন কোনো সস্ত্রাসী দলের হামলার পরিকল্পনার তথ্য নেই। তবে তাঁরা আশঙ্কা করছেন, ওই নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মালয়েশিয়া থেকে মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছে। তাঁর বাংলাদেশ অথবা নেপাল হয়ে ভারতে অনুপ্রবেশের পরিকল্পনা ছিল।
তবে ভারতে সম্ভাব্য জঙ্গি হামলার কোনো খবর পাননি বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তারা। তাঁরা জানান, সীমান্ত দিয়ে ভারতে কারো প্রবেশের বিষয়েও তাঁরা অবগত নন।
“বাংলাদেশ থেকে ভারতে সম্ভাব্য অনুপ্রবেশের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। ভারতও এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি,” বেনারকে বলেন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম।
ভারতীয় গণমাধ্যম জানায়, গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, চেন্নাইয়ের এক বাসিন্দা কুয়ালালামপুর থেকে আসা দুই লাখ ডলার তহবিলের একটা অংশ পেয়েছেন। এই টাকাটা ব্যাংকের মাধ্যমে নয় বরং হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পৌঁছায়।
মালয়েশিয়ার নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানান, তাঁদের সন্ত্রাসদমন কর্মকর্তারা এখনও ভারত থেকে কথিত আর্থিক লেনদেনের কোনো প্রমাণ পাননি। তবে এ ধরনের লেনদেনের ঘটনা ঘটেছে কি না তা মালয়েশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক খতিয়ে দেখা শুরু করেছে।
“বিএনএম (মালয়েশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক) এখনও আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। তবে, হাওয়ালার (হুন্ডি) মাধ্যমে লেনদেন হলে দাপ্তরিক কোনো নথিতে এর উল্লেখ থাকবে না। হাওয়ালার হিসাব প্রমাণ করা কঠিন, কারণ এর কোনো দাপ্তরিক রেকর্ড থাকে না এবং বিচারিক কার্যক্রমে ব্যাংকের হিসাব নিকাশের তুলনায় হাওয়ালার অভিযোগ গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা কম,” জানান ওই নিরাপত্তা কর্মকর্তা।
“যেহেতু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বলছে তারা আর্থিক লেনদেনের নথিপত্র নজরদারিতে এনেছে, আমি বিএনএম থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহের পরামর্শ দিচ্ছি, যেহেতু এই লেনদেনের সঙ্গে জাকির নায়েকের সম্পৃক্ততা আছে। আমরাও বিষয়টি নিয়ে তাঁদের বক্তব্যের অপেক্ষায় আছি।”
তবে এ বিষয়ে বেনারের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি বিএনএম।
কে এই নাসির?
ভারতীয় গণমাধ্যমে উল্লেখ করা রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ নাসির সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা নেই বলে বেনারকে জানান মালয়েশিয়ার কর্মকর্তারা।
ভারতীয় গোয়েন্দা তথ্যের দাবি, জাকির নায়েকের সঙ্গে নাসির এই টাকা পাঠিয়েছিলেন।
“এখন পর্যন্ত আমাদের রাডারে মোহাম্মদ নাসির নামে কেউ ধরা পড়েনি। ই-টু এবং ই-থ্রি স্থানীয় রোহিঙ্গা দলগুলোকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। রোহিঙ্গা এনজিও এবং তাঁদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখা হচ্ছে,” জানান ওই নিরাপত্তা কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত ই-টু এবং ই-থ্রি মালয়েশিয়ায় পুলিশের বিশেষ শাখার দুটি ইউনিট।
তিনি বলেন, “এ বিষয়ে ই-টু এবং ই-থ্রি কিছু জানে না বলে জানিয়েছে।”
মালয়েশিয়ায় সন্ত্রাস বিরোধী পুলিশের সাবেক প্রধান আয়ুব খান মাইদিন পিচাই বেনারকে বলেন, ২০১৯ সালে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) জঙ্গিগোষ্ঠীকে অর্থ পাঠানোয় জড়িত যে দলটি শনাক্ত হয়েছিল সেখানেও নাসির নামে কেউ ছিলেন না।
তিনি বলেন, “আমি যখন সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিটের প্রধান ছিলাম তখন এ নামটি শুনিনি। হয়তো এখানে তার অন্য নাম আছে। আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু আমি একটা বিষয়ে নিশ্চিত, আমরা তখন যে অপারেশন করেছিলাম তখন এ নামের কাউকে পাইনি।”
টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা খতিয়ে দেখছে, যে দলটি মিয়ানমারে আরসা জঙ্গিগোষ্ঠীকে টাকা পাঠিয়েছিল, সেটির সঙ্গে এই সম্ভাব্য হামলা পরিকল্পনার কোনো যোগসূত্র আছে কি না।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন।
২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর সেনা হামলার পর বেশিরভাগ রোহিঙ্গা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে চলে যান, এর মধ্যে কতজন মালয়েশিয়ায় গেছেন সে সম্পর্কে অবশ্য ইউএনএইচসিআর কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
‘ভুয়া খবর’
জাকির নায়েকের পক্ষে তাঁর মুখপাত্র বেনারকে বলেন, ভারতীয় প্রতিবেদনে নায়েকের সম্পৃক্ততা নিয়ে যে খবর বেরিয়েছে তা ভিত্তিহীন।
“ড. নায়েক সাধারণত এ ধরনের ভুয়া খবরে প্রতিক্রিয়া দেন না। টাইমস অব ইন্ডিয়া ভুয়া খবর ছেপেছে। প্রতিবেদনে তিনি কীভাবে সম্পৃক্ত তার কোনো ব্যাখ্যা নেই,” নায়েকের পক্ষ থেকে বেনারকে বলেন তাঁর মুখপাত্র। নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কায় তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি।
নায়েক একজন কট্টরপন্থী ইসলামিক টেলিভিশন বক্তা। তিনি ২০১৬ সালে ভারত ছাড়েন এবং মুসলিম অধ্যুষিত মালয়েশিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পান। তিনি ভারতে অর্থ পাচার এবং পিস টিভি থেকে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ২০১৬ সালের জুলাইতে ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফেতে ইসলামিক স্টেটের হামলাকারীদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য নায়েককে দায়ী করে থাকে। ওই হামলায় ২৯ জন নিহত হন, যাদের ২০ জনকে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল।
গত বছরের আগস্টে মালয়েশিয়া সাময়িকভাবে নায়েককে ধর্মোপদেশ দেওয়া থেকে বিরত রাখে। সে সময় তাঁর বিরুদ্ধে বহুজাতিভিত্তিক দেশ মালয়েশিয়ায় জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ তোলা হয়েছিল। যদিও ভারতে নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি মালয়েশিয়াতেই আশ্রয় নেন।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে প্রাপ্তি রহমান এবং কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল।