গবেষণা প্রতিবেদন: রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংগঠিত হচ্ছে আরসা
2020.01.09
ঢাকা

মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) বাংলাদেশে সংগঠিত হচ্ছে বলে দাবি করেছে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স অ্যান্ড টেররিজম রিসার্চ (আইসিপিভিটিআর)।
“এর ফলে মিয়ানমার ও বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের প্রতিবেশী দেশগুলোর নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক প্রভাব পড়বে,” মনে করছে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সংগঠনটি তাদের বার্ষিক নিরাপত্তা হুমকি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলেছে, “কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে বর্তমানে আরসা’র প্রায় ৩৫০০ যোদ্ধা আছে।”
এদিকে রোহিঙ্গা শিবিরে আরসা’র উপস্থিতি সম্পর্কে পুলিশ অবহিত নয় বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ।
বৃহস্পতিবার তিনি বেনারকে বলেছেন, “এ ব্যাপারে আমরা মোটেই অবহিত নই।”
তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেছেন, “রোহিঙ্গা শিবিরে ৩৫০০ আরসা সদস্যের উপস্থিতি মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।”
এদিকে শুধু রোহিঙ্গা নয়, ইরাক এবং সিরিয়ায় সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস পরাভূত হওয়ার পর সংগঠনটির বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়া জঙ্গিরা বাংলাদেশের জন্য ঝুকির কারণ বলে মনে করছে আইসিপিভিটিআর।
রোহিঙ্গা জঙ্গি সংকট
মিয়ানমারের মধ্যে আরসা দুর্বল ও বিভক্ত হয়ে গেলেও সন্ত্রাসী সংগঠনটি মিয়ানমারের বাইরে নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। রাখাইনে নতুন করে সহিংসতা তৈরি হলে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা সংকুচিত হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে ২০২০ সালের নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে কট্টরপন্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের পুনরুত্থানের কারণে দেশটিতে সহসাই শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা খুব কম থাকবে।
“আরসা’র যোদ্ধার সংখ্যা সম্পর্কে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য না থাকলেও সংবাদমাধ্যমের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রায় ৩৫০০ জন আরসা জঙ্গি থাকার ব্যাপারে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।”
আইসিপিভিটিআর এ ক্ষেত্রে জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়চে ভেলে পরিবেশিত গত ২৪ সেপ্টেম্বরের একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়েছে।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দুর্বল হয়ে গেলেও বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে আরসা আবারো সংগঠিত হচ্ছে বলে মনে করছে তারা।
আরসা জঙ্গিরা রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ব্যাপকভাবে সংগঠিত হচ্ছে এ রকম তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস এর সাধারণ সম্পাদক সাইদ উল্লাহ।
বেনারকে তিনি বলেছেন, “রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়। তারা কোনো প্রকার জঙ্গিবাদে যুক্ত হতে চায় না।”
তাদের দাবিগুলো মেনে নিয়ে মিয়ানমারে নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তাসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে কেউ জঙ্গিবাদের পথে হাঁটবে না বলে মনে করেন এই রোহিঙ্গা নেতা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বেনারকে বলেছেন, “রোহিঙ্গা শিবিরে আরসা সংগঠিত হচ্ছে এ রকম তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদনটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে তার অর্থ এই নয় যে ভবিষ্যতে হতে পারে না।”
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ পুনর্বাসনই এ ক্ষেত্রে প্রকৃত সমাধান।”
এদিকে “হয়তোবা দু-একজন আরসা সদস্য গোপনে থাকতে পারে। তবে ৩৫০০ আরসা যোদ্ধা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আছে - এ রকম কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়,” বলে মন্তব্য করেছেন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান না হলে এই ক্ষুব্ধ আশ্রয়হীন মানুষগুলোকে যেকোনো উগ্রবাদী গ্রুপ তাদের মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে সহজেই সংগঠিত করতে পারে। সুতরাং এই সমস্যা জিইয়ে রাখলে ভবিষ্যতে জঙ্গি সমস্যা প্রবল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।”
বিক্ষিপ্ত আইএস হুমকি
ইরাক এবং সৌদি আরবে হেরে গেলেও আইএস মতাদর্শ বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি বলে মনে করছে আইসিপিভিটিআর।
২০১৯ সালে আইএস এর সেলগুলো বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর কিছু চোরাগোপ্তা হামলা চালালেও এই গ্রুপের সদস্যদের একক (লোন-উলফ) আক্রমণের সম্ভাবনা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আল কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত গোষ্ঠীগুলোকে শনাক্ত ও ব্যর্থ করতে সাধারণভাবে সফল হলেও তাদের নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের সম্ভাবনা রয়ে গেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেশী দেশের প্রভাবে জঙ্গিবাদের শঙ্কা
বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ মৌলবাদের উত্থান অনেকখানি প্রভাবিত হবে প্রতিবেশী ভারত এবং মিয়ানমারের ধর্মীয়-রাজনৈতিক চলমান স্রোতের কারণে। ভারতে হিন্দুত্ববাদী এবং মিয়ানমারে বৌদ্ধ চরমপন্থার বিকাশের কারণে বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদ সৃষ্টির সুযোগ বাড়ছে বলে আইসিপিভিটিআর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
সংগঠনটির এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক আব্দুর রশীদ এবং সাখাওয়াত হোসেন।
আব্দুর রশীদ বলেন, “ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বাড়লে বাংলাদেশে যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে চায় তারা সুবিধা পায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত জুড়ে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আন্দোলন বলে দেয়, অঞ্চলে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্ষেত্রটিও উর্বর।
“ভারতে হিন্দুত্ববাদের প্রভাব বাড়লে এবং মিয়ানমারে বৌদ্ধ চরমপন্থা বাড়লে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডেফিনিটলি এর প্রভাব পড়বে,” বলেন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত।