সীতাকুণ্ডে আটক জঙ্গি দম্পতি ১২ দিনের রিমান্ডে, নারী রোহিঙ্গা
2017.03.17
ঢাকা

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জঙ্গি আস্তানা থেকে পুলিশের হাতে আটক জঙ্গি দম্পতি জসিম ও আর্জিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে চট্টগ্রামের বিচারিক হাকিম হোসেন মো. রেজার আদালতে আসামিদের হাজির করে দুই মামলায় ১৫ দিন করে মোট ৩০ দিন রিমান্ডের আবেদন জানায় পুলিশ। শুনানি শেষে আদালত অস্ত্র মামলায় পাঁচদিন এবং সন্ত্রাস দমন আইনের মামলায় সাতদিনসহ মোট ১২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে শুক্রবার সকালে সীতাকুণ্ড থানায় হত্যা, অস্ত্র, বিস্ফোরক ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জসিম ও আর্জিনা দম্পতিকে আসামী করে পুলিশ চারটি মামলা করে।
এ প্রসঙ্গে সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইফতেখার হাসান বেনারকে বলেন, “সময় স্বল্পতায় বাকি দুটি মামলায় রিমান্ড আবেদন জমা দেওয়া যায়নি। তবে পরবর্তীতে আবারও ওই মামলায় রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানানো হবে।”
গত বুধবার বাড়িওয়ালার দেওয়া তথ্যে সীতাকুণ্ড পৌরসভার আমিরাবাদ এলাকায় সাধন কুটিরে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়ার পর অভিযান চালিয়ে এই জঙ্গি দম্পতিকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ওই দিনই সীতাকুণ্ড পৌর এলাকার প্রেমতলায় ছায়ানীড় নামের আরেক বাড়িতে দীর্ঘ ১৯ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে বিপুল বিস্ফোরক উদ্ধার করে। এ অভিযানের সময় আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ও গুলিতে নারীসহ চার জঙ্গি নিহত হন। পরে ঘটনাস্থল থেকে বোমায় বিক্ষত এক শিশুর লাশ পাওয়া যায়।
পুলিশ সূত্র জানায়, মিথ্যে নামে বাসা ভাড়া নিয়েছিল জসিম ও আর্জিনা। তাদের প্রকৃত নাম জহিরুল ও রাজিয়া। এর মধ্যে রাজিয়া রোহিঙ্গা। ভুয়া পরিচয়পত্র দিয়ে জঙ্গি জসিমই দুটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল।
এদিকে নিহত চার জঙ্গির মধ্যে দুজনের নাম পরিচয় পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এরা হচ্ছে; কামাল ও জোবায়দা। নিহত শিশুটি তাদের সন্তান। অপর দুজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপ কমিশনার আবদুল মান্নান বেনারকে বলেন, পুলিশের খাতায় নিখোঁজ রাজধানীর মিরপুর এলাকার দুই খালাতো ভাই ওই ঘটনায় নিহত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তাদের দেহ এমনভাবে ছিন্নিভিন্ন হয়েছে যে, ডি এন এ টেস্ট ছাড়া পরিচয় নিশ্চত হওয়া সম্ভব নয়।
সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকেরা বলছেন, জঙ্গিরা প্রতিনিয়ত তাঁদের কৌশল বদলাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পেশাগত দক্ষতা দিয়ে জঙ্গি দমনে সফলতা আনলেও পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “জঙ্গিরা সব সময় কৌশল পরিবর্তন করতে থাকে। এখনকার ভয়াবহতা হলো আত্মঘাতী হামলা। এর ভয়াবহতা কোন পর্যন্ত যাবে বলা যাচ্ছে না।”
আহতের চিকিৎসা চলছে
সীতাকুণ্ডের প্রেমতলা এলাকার ছায়ানীড় নামক বাড়িটিতে অভিযানে সময় পুলিশের সোয়াট (স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিকস) দলের তিন সদস্যসহ আহত পাঁচজনকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলাকালে গত বুধবার বিকেলে ও বৃহস্পতিবার ভোরে গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন তাঁরা।
আহতদের মধ্যে ঢাকা সোয়াটের সদস্য কনস্টেবল শরীয়ত হাসান ও মোহাম্মদ আসিব চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আহত অন্যরা হলেন; সোয়াটের চট্টগ্রাম নগরের সদস্য ও অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মির্জা সায়েম মাহমুদ, সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোজাম্মেল হক এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মী মঈন উদ্দিন। তাঁরা সীতাকুণ্ড ও চট্টগ্রামে চিকিৎসা নেন।
চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আহতদের মধ্যে শরীয়তের পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। গ্রেনেড বিস্ফোরণে থুতনি কেটে গেছে এবং তিনটি দাঁত ফেলে দিতে হয়েছে। তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্প্লিন্টারের আঘাত রয়েছে। এ ছাড়া সোয়াট সদস্য আসিবের শরীরের বিভিন্ন অংশে জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেডের স্প্লিন্টার লেগেছে। ফেটে গেছে কানের পর্দা।
এক বাড়িওয়ালা আতঙ্কে, নজরদারিতে অন্যজন
নিজের বাসায় জঙ্গিরা আশ্রয় নিয়েছে বলে পুলিশের খবর দেওয়া ‘সাধন কুটির’ এর মালিক সুভাষ চন্দ্র দাশ ও তাঁর পরিবার এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
গত বুধবার তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই জঙ্গি জসিম ও আর্জিনাকে আটক করে পুলিশ।
বাড়ির মালিক সুভাষ বেনারকে জানান, ওই বাসায় এক নারীসহ তিনজন পুরুষ ছিল। এদের মধ্যে নারীসহ দুজন ধরা পড়লেও বাকিরা আগের রাতে পালিয়ে যায়।
“এখন পরিবার সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে ভয়ে আছি। তারা সঙ্গীদের ধরিয়ে দেওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে যেকোনো সময় হামলা চালাতে পারে,” বলেন সুভাষ।
পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছেন বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “যারা পুলিশকে সহযোগিতা করেছেন, আমরা তাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেবো।”
সুভাষের বাড়ির সামনে পাঁচজন পুলিশ সার্বক্ষণিক পাহারা দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “পাশাপাশি পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গিকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।”
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, জঙ্গি দমনে যারা এগিয়ে আসছেন, পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের পরিচয় গোপন রাখাও জরুরি।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলছিলেন, “যে বাড়িওয়ালা জঙ্গিদের তথ্য দিয়েছেন, তাঁর পরিচয় গোপন রাখা পুলিশের দায়িত্ব ছিল। জঙ্গি দমনের পাশাপাশি সন্ধানদাতাদের নিরাপত্তার কথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভাবতে হবে।”
অন্যদিকে চার জঙ্গি ও এক শিশু নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া অভিযানের পর, ‘ছায়া নীড়’ বাড়ির মালিক ও তাঁর পরিবার সদস্যদের পুলিশ তুলে নিয়ে যায়।
পুলিশ সুত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁরা পুলিশের নজরদারিতে রয়েছেন।