করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে বাংলাদেশ ফেরতাদের যোগ থাকতে পারে
2020.10.07

মিয়ানমারে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের পেছনে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ঢুকে পড়ার যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মনে করছেন ইয়াঙ্গুনের জ্যেষ্ঠ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর কারণে বিপজ্জনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
বছরের প্রথম ছয়মাস মিয়ানমার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় তার প্রতিবেশী দেশ ক্যাম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের মতো কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু আগস্টের মাঝামাঝি থেকে পাঁচ কোটি ৪০ লাখ জনগোষ্ঠীর দেশটিতে আবারও প্রাণঘাতী ভাইরাসটি ফিরে আসে।
“রাখাইন থেকে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ এর উৎপত্তি হতে পারে,” ড. খিন খিন জিওয়াইআই রেডিও ফ্রি এশিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন। মিয়ানমারের স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ এবং নির্মূল বিভাগের পরিচালক হলেন খিন খিন জিওয়াইআই।
“সংক্রমিত হতে পারেন এমন ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারীদের হার বেশি,” তিনি বলেন।
“ওখান থেকে রাখাইনে সংক্রমন ছড়িয়েছে, তারপর ইয়াঙ্গুন থেকে মিয়ানমারের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়েছে প্লেনের মাধ্যমে” খিন খিন জিওয়াইআই বলেন।
অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের মতোই রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ‘ফেরত’ আসা মানুষ বলে উল্লেখ করেন খিন খিন জওিয়াইআই। কারণ মিয়ানমারে মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব স্বীকার করে না। রাখাইনের হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে বিবেচনা করে। এই যুক্তি দেখিয়ে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বঞ্চিত করে রেখেছে।
বুধবার পর্যন্ত মিয়ানমারে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২১ হাজার ৪৩৩ জন। মৃতের সংখ্যা ৫১০ এবং সেরে উঠেছেন ছয় হাজার ৮৪ জন।
অন্যদিকে বাংলাদেশ এখন করোনা সংক্রমণের দিক থেকে বিশ্বে ১৬তম অবস্থানে আছে। বুধবার পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৭৩ হাজার ১৫১ জন। মারা গেছে ৫ হাজার ৪৪০ জন এবং সুস্থ হয়েছে ২ লাখ ৮৬ হাজার ৬০০ জন।
বছরের শুরুর দিকে যখন বাংলাদেশে সংক্রমণের হার বাড়তে থাকে, সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দারা কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছিলেন যেন বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ঢুকতে না পারে এবং বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফের সঙ্গে রাখাইনের মংডুর যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে তা যেন স্থগিত করা হয়।
১ অক্টোবর মংডুর প্রশাসক অং সয়ে আরএফএকে বলেন, অর্থনৈতিক প্রয়োজনে বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত দুই অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যিক কার্যক্রম সচল ছিল। তা ছাড়া এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে দেড়শ রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির থেকে ফিরে আসেন।
তিনি বলেন, তাঁদের আটজন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ছিলেন। তা ছাড়া টেকনাফের সঙ্গে বাণিজ্য করেছেন এমন তিন রোহিঙ্গার মধ্যেও সংক্রমণ দেখা গেছে।
মিয়ানমারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, জুন, জুলাই ও আগস্টে বাংলাদেশে ভ্রমণ করেছেন এমন ১৪ জনের দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
কিন্তু রাখাইনের জনস্বাস্থ্য বিভাগের পরিচারক ডা. সাই উইন জ হ্লাইং বলেন, কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশ থেকে এসেছে কি না এবং রাখাইন থেকে মিয়ানমারে ছড়িয়ে পড়েছে কি না তা যাচাই করা কঠিন।
“আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না মংডুতে যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের সঙ্গে সিটওয়েতে আক্রান্তদের যোগ রয়েছে,” তিনি বলেন।
“ইয়াঙ্গুন থেকে রাখাইনে বিমান চলাচল রয়েছে এবং বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গাড়িতে করেও এখানে (রাখাইনের রাজধানীতে) অনেকে এসেছেন।”
“আবার নৌকায় করে অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষও আছেন,” তিনি আরও বলেন। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নৌ চলাচল বিচ্ছিন্ন করেছে সরকার।
তিন বছর আগে মিয়ানমারের বাহিনী রাখাইনের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকায় রোহিঙ্গাদের ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। হাজার হাজার মানুষ এতে নিহত হন, ৭ লাখ ৪০ হাজারের মতো মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের ঘনবসতিপুর্ণ শরণার্থীশিবিরগুলোতে এসব মানুষের আশ্রয় জোটে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সিংহভাগ রাখাইনে ফিরতে চান না। কারণ বৈষম্য ও নির্যাতনরোধী কোনো নীতি নেই সেখানে। তবে কিছু মানুষ আনুষ্ঠানিক প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর আগেই সীমান্ত অতিক্রম করে ফিরে গেছেন।
কোভিড-১৯ আক্রান্তের দিক থেকে দশ সদস্য রাষ্ট্রের আসিয়ানের (অ্যাসোসিয়শন অফ সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনস) মধ্যে মিয়ানমারের অবস্থান চতুর্থ। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরের পরই রয়েছে দেশটি।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমারে সংক্রমণের উৎস খোঁজার ক্ষেত্রে বড় প্রতবিন্ধকতা হলো সীমিত কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, করোনাভাইরাস প্রতিরোধের শর্তগুলো ঠিকঠাক না মানা এবং শুধু বাংলাদেশ নয় থাইল্যান্ড, চীন ও ভারতের সঙ্গে প্রায় অরক্ষিত সীমান্ত থাকা।
রেডিও ফ্রি এশিয়ার মিয়ানমার সার্ভিস প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
অনুবাদ: প্রাপ্তি রহমান