ঢাকা আসছেন পোপ ফ্রান্সিস, দেখা করবেন রোহিঙ্গাদের সাথেও

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.11.29
ঢাকা
পোপ ফ্রান্সিস এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি টানানো হয়েছে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে। পোপ ফ্রান্সিস এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি টানানো হয়েছে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে। ২৯ নভেম্বর ২০১৭ ।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ

বিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের আগমন উপলক্ষে বাংলাদেশের সব আয়োজন এখন চূড়ান্ত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুরু হওয়া এই সফরে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করবেন। শনিবার রোমের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে যাবার আগে রোহিঙ্গাদের একটি দলের সাথেও তাঁর সাক্ষাৎকার করার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইউরোপ অনুবিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খাস্তগির বুধবার বেনারকে বলেন, “৩১ বছর পর বাংলাদেশে কোনো পোপ আনুষ্ঠানিক সফরে আসছেন। এর আগে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন পোপ দ্বিতীয় জন পল।”

তিনি বলেন, “রাষ্ট্রীয় সফরের সব প্রস্তুতি আমরা চূড়ান্ত করে এনেছি। আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছি।”

“তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকবেন মাননীয় রাষ্ট্রপতি,” বলেন খাস্তগির।

রোহিঙ্গাদের সাথে দেখা করবেন

পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে আসছেন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান পরিচালনার প্রেক্ষিতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচানার মুখে দেশটিতে পোপের এই সফর অনুষ্ঠিত হলো।

এটিই ছিল মিয়ানমারে কোনো পোপের প্রথম সফর। পোপ ফ্রান্সিস এর আগে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রার্থনা করলেও মিয়ানমার সফরকালে তিনি ‘রোহিঙ্গা’ কথাটা ব্যবহার করেননি।

তবে মঙ্গলবার তিনি দেশটির নেত্রী আং সান সূ চিসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে পরোক্ষভাবে রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে “মানবাধিকারের প্রতি সম্মান” প্রদর্শন করতে আহ্বান জানান।

প্রসঙ্গত, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী হিসেবে গণ্য করে এবং রোহিঙ্গার পরিবর্তে বাঙালি হিসেবে উল্লেখ করে থাকে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে গত আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত সোয়া ছয় লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ সফরকালে পোপ রোহিঙ্গাদের একটি দলের সাথে দেখা করবেন বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র।

“আর্চ বিশপের বাসভবনে অনুষ্ঠিতব্য সম্মিলনীর আগে বা পরে কোনো একটা সময় পোপ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি দলের সঙ্গে দেখা করবেন,” বলেন মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খাস্তগির।

“তিনি (পোপ) শরণার্থীদের, শান্তি ও সম্প্রীতির কথা বলেন। আমরাও একই মূল্যবোধের চর্চা ও প্রসার করে থাকি। পোপ ফ্রান্সিস যখন এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলবেন, তখন তা আমাদের অবস্থানকেই আরও সংহত করবে,” বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা।

আনন্দে ভাসছে খ্রিস্টান সম্প্রদায়

পোপের সফর উপলক্ষে দেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ এখন আনন্দে ভাসছেন।

“আমি সারা জীবন এই মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করে থেকেছি। আমার স্বপ্ন ছিল জীবনে একবার নিজের চোখে পোপকে দেখব। ভাবতেও পারিনি আমার স্বপ্ন সফল হবে। তিনি নিজেই আমাদের দেখতে আসছেন। আমার স্বপ্ন এখন সত্যি হওয়ার পথে,” বেনারকে বলেন আগস্ট হাজদা নামের একজন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।

“আমরা কখনো ভাবিনি এত কম খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত দেশ সফরে পোপ কখনো আসবেন,” বেনারকে বলছিলেন প্যাট্রিক ডি কস্তা।

বাংলাদেশে খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী দেশে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখের মতো। যার মধ্যে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মানুষ প্রায় চার লাখ।

নাটোর থেকে নিখোঁজ পোপের এক অনুষ্ঠান সংগঠক

নাটোর থেকে কমপক্ষে তিন শ খ্রিস্টানকে নিয়ে ঢাকার হোলি মাসে অংশ নেওয়ার কথা ছিল ক্যাথলিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক ওয়াল্টার উইলিয়াম রোজারিও’র। সোমবার রাত থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় পুলিশ ও সংশ্লিষ্টরা।

যদিও পুলিশ বলছে ওয়াল্টার রোজারিওকে খুঁজে পেতে তারা সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছে।

ওয়াল্টার নিখোঁজ হওয়ার পর তাঁর পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবি করা হয় বলে জানিয়েছেন তাঁর স্বজনেরা। তবে পুলিশ মনে করছে, ফোন কলটি ছিল ভুয়া। পুলিশ ওয়াল্টারের নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না।

জোরদার নিরাপত্তা

পোপের সফর উপলক্ষে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

“পোপ আমাদের সম্মানিত রাষ্ট্রীয় অতিথি। আমরা তাঁর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করব,” বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

তিনি বলেন, “পোপের আগমন উপলক্ষে যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, সেই কর্মসূচিগুলো যেন নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হতে পারে সে জন্য প্রতিটি অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন থাকবে।”

“বাংলাদেশের মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ ও অতিথিপরায়ণ। তাঁরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

পোপের সফরসূচি

আনুষ্ঠানিক সফরসূচি অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ৩টায় পোপ হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হবে।

শুধুমাত্র রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এই রীতি অনুসরণ করা হয়। বিমানবন্দরে তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করার কথা রয়েছে।

ওইদিন বিকেল তিনি প্রথমে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবেন। এর পর তাঁর বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে যাবার কথা রয়েছে।

এরপর তিনি প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের সঙ্গে বঙ্গভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে মন্ত্রী, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও কূটনীতিকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন।

ঢাকায় ভ্যাটিকান রাষ্ট্রদূতের আবাসস্থলে পোপ ফ্রান্সিসের থাকার কথা রয়েছে।

পরদিন শুক্রবার সকালে পোপ ফ্রান্সিস সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্মল রোজারিও বেনারকে বলেন, “পোপের আগমন উপলক্ষে হোলি মাস ও আনুষ্ঠানিকভাবে যাজক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান অনুষ্ঠানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৮০ হাজার মানুষ সমবেত হওয়ার কথা রয়েছে।”

এদিন বেলা ৩টা ২০ মিনিটে ভ্যাটিকান দূতাবাসে পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিকেল ৫টার দিকে পোপ ফ্রান্সিস ঢাকার রমনা ক্যাথেড্রালে যাবেন। রমনায় আর্চ বিশপের বাসভবনে আন্তঃধর্মীয় প্রীতি সম্মিলনী ও ধর্মগুরুদের সঙ্গে মতবিনিময়ের কথা রয়েছে তাঁর।

সফরের শেষ দিন শনিবার সকাল ১০টায় পোপ ফ্রান্সিস তেজগাঁওয়ে মাদার তেরেসা হাউস পরিদর্শনে যাবেন। ঢাকার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড় অংশ এই এলাকায় থাকেন।

এছাড়া পোপ প্যারিস সেমিট্রি ও হোলি রোজারির প্রাচীন গির্জা পরিদর্শন করবেন। এরপর বেলা ৩ টা ২০ মিনিটে তিনি ঢাকার নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করবেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী পোপ ফ্রান্সিসকে বিকেল ৫টায় বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে উপস্থিত থাকবেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।