বাংলাদেশের মানুষ উদারতা ও সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত রেখেছে: পোপ ফ্রান্সিস

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.11.30
ঢাকা
ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ৩০ নভেম্বর ২০১৭।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ উদারতা ও সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত রেখেছে। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে অবস্থানরত ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁর ভাষণে এ কথা বলেন। রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবনে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সাংসদ, ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে পোপ ফ্রান্সিস এই ভাষণ দেন।

তিনি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে ইসলামি মৌলবাদ ও সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্বের কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের চিরায়ত ঐতিহ্য।

“উদারতা ও সহমর্মিতা বাংলাদেশি সমাজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আর এ বৈশিষ্ট্যের উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে। রাখাইন রাজ্য থেকে আসা বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে মানবিক সহায়তা দিয়েছে তাঁরা। এসব শরণার্থীকে তাঁরা সাময়িক আশ্রয় দিয়েছে, তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সহযোগিতা করেছে,” পোপ ফ্রান্সিস বলেন।

বাংলাদেশে আসার পর এ দেশের জনগণের জন্য এটিই তাঁর প্রথম ভাষণ।

তিনি বলেন, “এটা কোনো সামান্য উৎসর্গ নয়। পুরো বিশ্ব সম্প্রদায়ের চোখের সামনে বাংলাদেশের মানুষ এই অবদান রেখেছে। এই পরিস্থিতির ব্যাপকতা অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই, এর সঙ্গে মিশে আছে বহু মানুষের যন্ত্রণা, আমাদেরই ভাই-বোনেরা যাদের আবার বড় অংশ নারী ও শিশু, শরণার্থী শিবিরগুলোয় গাদাগাদি করে কোনো রকমে বসবাস করছে।”

সংকট সমাধানের দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের

মিয়ানমারের মতো বাংলাদেশে এসেও পোপ ফ্রান্সিস রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তিনি রোহিঙ্গাদের ‘রাখাইন থেকে আসা শরণার্থী’ হিসেবে উল্লেখ করে এই সমস্যা মোকাবেলায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

“এই গভীর সংকট সমাধানের দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর বর্তায়। তাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। শুধুমাত্র যে রাজনৈতিক কারণে এই মানুষগুলোকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে তার সমাধানই যথেষ্ট নয়। বিপন্ন মানুষকে যেন বাংলাদেশ আরও কার্যকরভাবে সহযোগিতা করতে পারে সে জন্য সবাইকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে,” পোপ ফ্রান্সিস বলেন।

বাংলাদেশের মানুষ সুপ্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী মানুষের প্রিয় আবাসস্থল, কিন্তু ধর্মকে প্রায়ই অন্যায়ভাবে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পোপ ফ্রান্সিস তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, “অন্যায্য আচরণ থেকে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় তারই প্রতিফলন ঘটে গত বছর ঢাকায় ঘটে যাওয়া বর্বর সন্ত্রাসী হামলায় এবং এ দেশের ধর্মীয় নেতারা পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন ঈশ্বরের নাম নিয়ে মানুষ হয়ে মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণাসূচক ও সহিংস কার্যক্রম কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।”

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁর ভাষণে বলেন, পোপের এই সফর “বাংলাদেশে পরমত সহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের যে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য তার স্বীকৃতি।”

তিনি বলেন, “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার, বাংলাদেশের মানুষ অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই মন্ত্রকে ধারণ করে। বাংলাদেশের মানুষ স্মরণাতীত কাল থেকে একে অন্যের ধর্মকে শ্রদ্ধা করে ও ধর্মীয় উৎসবে শামিল হয়ে আসছে।”

মানুষ যেন ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে তার নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাসের চর্চা করতে পারে সে ব্যাপারে ভ্যাটিকানের যে আদর্শ, বাংলাদেশও সেই একই আদর্শের অনুসারী বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।

অসহায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে পোপের অবস্থানের প্রশংসা করে রাষ্ট্রপতি বলেন, “বর্বরোচিত হামলা বন্ধে আপনি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। এই আহ্বান আশা জাগায় যে হয়ত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে।”

ঢাকায় পোপের প্রথম দিন

বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার থেকে তিনিদিনের সফর শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৩ টা ৫ মিনিটে তিনি ঢাকায় পৌঁছান। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ থেকে ২১ বার তোপধ্বনি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়।

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান।

ঢাকায় পোপ ফ্রান্সিসের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে তিনি যে যে সড়ক অতিক্রম করেছেন সে সড়কগুলোয় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মোতায়ের করা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য।

পোপ ফ্রান্সিসের নিরাপত্তার দায়িত্বে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স কাজ করছে। সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধানদের নিরাপত্তায় এই বাহিনী নিয়োগ করা হয়।

বিকেল ৪টায় পোপ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে।

পোপকে অভ্যর্থনা জানাতে সড়কের দুপাশে বিপুলসংখ্যক মানুষ দাঁড়িয়েছিল। পোপ ফ্রান্সিসের আগমন উপলক্ষে প্রধান সড়কগুলো তাঁর ছবি দিয়ে সজ্জিত করা হয়।

কড়া নিরাপত্তা প্রহরার মধ্য দিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে পোপ আসেন ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা এ সময় পোপের সঙ্গে ছিলেন।

বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে পোপ ফ্রান্সিস রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এরপর বঙ্গভবনের দরবার হলে উপস্থিত হন মন্ত্রী পরিষদ সদস্য, সাংসদ, কূটনীতিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।

রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম বিটিভি পোপের সফর সরাসরি প্রচার করেছে গতকাল।

পোপ ফ্রান্সিস সফরকালীন ঢাকায় ভ্যাটিকান দূতাবাসে অবস্থান করবেন। শুক্রবার সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি হোলি মাস ও প্রিস্টলি অর্ডিনেশন উপলক্ষে ৮০ হাজার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর একটি জমায়েতে উপস্থিত হবেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।