রোহিঙ্গাদের পাশে থাকার অঙ্গিকার পোপ ফ্রান্সিসের
2017.12.01
ঢাকা

রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন পোপ ফ্রান্সিস। শুক্রবার কাকরাইলে সেইন্ট মেরিজ ক্যাথেড্রালে আন্তঃধর্ম সম্মিলনী ও মাণ্ডলিক সভা চলাকালে পোপ এ কথা বলেন।
এ সময় পোপ ফ্রান্সিস তিনটি রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। ষোল জনের রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলটি পোপকে মিয়ানমারে তাঁদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে এবং কীভাবে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তার বিবরণ দেন। পোপ তাঁদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
পোপ বলেন, “আমরা আপনাদের যন্ত্রণা ও কষ্ট বুঝতে পারছি। পৃথিবীর সব প্রান্তেই মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, সেখানে শান্তি স্থাপনে আমরা কাজ করছি। ঈশ্বর আপনাদের মাঝে বিরাজিত। যারা আপনাদের ওপর অত্যাচার করেছে, কষ্ট দিয়েছে, তাদের পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা চাইছি। আপনারা বিশাল হৃদয়ের অধিকারী। আপনারা আমাদের ক্ষমা করে দিন।”
পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে সাক্ষাতের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুথিডং থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী নুরুল্লা বেনারকে বলেন, পোপের উদ্যোগে হয়তো তাঁরা বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন।
“একজন সম্মানিত ধর্মগুরুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমরা এখন আশাবাদী। আমরা তাঁর কাছে তিনটি দাবি জানিয়েছি। আমাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও যারা আমাদের স্বজনদের হত্যা করেছে, নির্যাতন করেছে ও আমাদের নারীদের ধর্ষণ করেছে তাদের বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারে তিনি যেন উদ্যোগী হন,” বলেন নুরুল্লা।
নুরুল্লা বেনারকে বলেন, পোপ ফ্রান্সিস তাঁদের বলেছেন, ঈশ্বর নিশ্চয়ই তাঁদের সমস্যার সমাধান করবেন।
পরে রোহিঙ্গাদের জন্য সেইন্ট মেরিজ ক্যাথেড্রালে একটি বিশেষ প্রার্থনা সভার আয়োজন করা হয়। তাঁরা যেন নির্বিঘে, শান্তিপূর্ণভাবে ও সম্মানের সঙ্গে নিজেদের বাসভূমিতে ফিরতে পারেন সে জন্য প্রার্থনা করেন পোপ ফ্রান্সিস।
ঢাকায় পোপ ফ্রান্সিসের কর্মব্যস্ত দিন
সফরের দ্বিতীয় দিন ঢাকায় পোপ ফ্রান্সিস ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। এ দিন সকালে তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৮০ হাজার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর একটি জমায়েতে উপস্থিত হন। তাঁর পৌরহিত্যে আনুষ্ঠিত হয় গণপ্রার্থনা। অনুষ্ঠিত হয় যাজকদের অভিষেক অনুষ্ঠান।
প্রার্থনা সভার বিভিন্ন অংশে বাংলা, ইংরেজি, ল্যাটিন ও স্প্যানিশ ভাষা ব্যবহার করা হয়। গারো, ওঁরাও এবং সাঁওতাল ভাষায় প্রার্থনা সংগীত গাওয়া হয়।
সকাল সাড়ে নয়টায় পোপ ফ্রান্সিস সভাস্থলে উপস্থিত হলেও মানুষের ঢল নামে ভোর ছয়টা থেকে। সভায় উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরাও। অনুষ্ঠানস্থল ঘিরে ছিল কড়া নিরাপত্তা।
অনুষ্ঠানে নতুন অভিষিক্ত ১৬ যাজকদের উদ্দেশ্যে পোপ বলেন, “যাজকদের দায়িত্ব মানবকল্যাণে নিজেদের উজাড় করে দেওয়া। যারা পথের দিশা পাচ্ছে না তাদের পথের সন্ধান ও সুরক্ষা দেওয়া।”
বিভেদ সৃষ্টিকারীদের তিরস্কার
বিকেলে কাকরাইল আর্চ বিশপ হাউসে আন্তঃধর্ম সম্মিলনী ও মাণ্ডলিক সভায় পোপ ফ্রান্সিস বলেন, যারা ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে এই সভার মাধ্যমে তাদের তিরস্কার করা হয়।
সভায় মুসলমান, হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের নেতৃবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন।
পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “বিশ্বের সব ধর্মের মর্মকথা হলো সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ ও শান্তি।”
তিনি বলেন, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সম্প্রীতির সঙ্গে এ দেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ সহাবস্থান করবে, আন্তঃধর্মীয় সভা সবার কাছে এই বার্তাই পৌঁছে দিয়েছে।
সভায় পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের পাশাপাশি মানুষের হৃদয়ে বোধ জাগিয়ে তোলার তাগিদ দেন পোপ ফ্রান্সিস।
তিনি বলেন, “ধর্মীয় বৈচিত্র্য কোনো হুমকি নয়। বরং নিজেদের সমৃদ্ধ করা ও হৃদয়কে আরও প্রসারিত করার হাতিয়ার। সমৃদ্ধ মানুষ অন্যকে তার পথের বাধা বলে মনে করে না, বরং বৈচিত্র্যের মধ্যেই পথ খুঁজে নেয়।”
বাংলাদেশের মানুষের প্রশংসা করে পোপ বলেন, “বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বাস। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে তাঁদের হৃদয়ের উদারতার প্রমাণ রেখেছেন। রানা প্লাজা ধসের পর আমি সব ধর্মের মানুষকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখেছি, প্রার্থনা করতে দেখেছি, বিপন্নের কল্যাণে একাত্ম হতে দেখেছি। এখানে আমরা দেখেছি কীভাবে মানুষের প্রতি মানুষ সেবার হাত প্রসারিত করে।"
তিনি বলেন, বিশ্বে এখন হৃদয়বান মানুষের খুব প্রয়োজন। রাজনৈতিক অসদাচারণ; ধর্মের নামে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড; দারিদ্র, শরাণার্থী, নির্যাতিত, সংখ্যালঘু ও ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে দেখেও না দেখার ভান করার মতো কাজ প্রতিহত করতে হৃদয়কে প্রসারিত করতে হবে।
আন্তঃধর্ম সম্মিলনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি রোজারিও। মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন মাওলানা মাসুদ। স্বামী রুবেশানন্দ হিন্দু সম্প্রদায় ও সঙ্ঘনাথ শুদ্ধানন্দ মহাথেরো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন।
মাওলানা মাসুদ রোহিঙ্গাদের পক্ষে পোপের অবস্থানের প্রশংসা করেন।
“হিজ হোলিনেস পোপ ফ্রান্সিসের সমর্থন নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখবে,” মাওলানা মাসুদ বলেন।
তিনি আরও বলেন জঙ্গিবাদ রুখতে পোপের এই সফরের তাৎপর্য ব্যাপক।
“নানা নদী নানা পথে বহমান। কিন্তু তাদের গন্তব্য একই জায়গায় - সাগরে। সব ধর্মের মূল বাণী একই,” বলেন স্বামী রুবেশানন্দ।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নেতা সঙ্ঘনাথ শুদ্ধানন্দ মহাথেরো মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের সমালোচনা করে বলেন বৌদ্ধ ধর্ম শান্তির কথা বলে, সহিংসতার নয়।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা শরণর্থীদের অবশ্যই সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের সুযোগ দিতে হবে।”
ভ্যাটিকান দূতাবাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
শুক্রবার দুপুরে ভ্যাটিকান দূতাবাসে পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি পোপকে একটি নৌকা উপহার দেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদকিদের বলেন, শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর পোপের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। এ সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা, রেহানার ছেলে রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও ছেলের বৌ পেপে সিদ্দিক ছিলেন।
সফর শেষ হচ্ছে শনিবার
শনিবার বিকেল পাঁচটায় রোমের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন পোপ ফ্রান্সিস। বিমানবন্দরে তাঁকে বিদায় জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
তবে সকাল থেকেই পোপ ফ্রান্সিসের দিন কাটবে ব্যস্ততায়। সকালে প্রথমেই তেজগাঁয়ে মাদার তেরেসা হাউজে যাওয়ার কথা রয়েছে তাঁর। বেলা পৌনে ১১টায় তেজগাঁও হোলি রোজারিও চার্চে মতবিনিময় করবেন। তেজগাঁওয়ের পুরনো গির্জা ও কবরস্থানেও তাঁর যাওয়ার কথা রয়েছে। বিকেল তিনটা ২০ মিনিটে পোপ ফ্রান্সিস নটরডেম কলেজে যুব সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন।