মিয়ানমারে রাখাইনদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছে বাংলাদেশি রাখাইনেরা
2020.10.12
ঢাকা

আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২০। ইস্টার্ন সময় সকাল ১০:০০
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো রাজপথে নেমেছে বাংলাদেশে বসবাস করা রাখাইন জনগোষ্ঠী।
তাঁদের দাবি, ওই রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ রাখাইনরাও জাতিগত নিধনের মুখে রয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে রাখাইন বৌদ্ধরাও রোহিঙ্গাদের মতো বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে।
“সুপরিকল্পিতভাবে পুরো রাখাইন জাতিকে আরাকান থেকে মুছে ফেলার লক্ষ্যে ভয়াবহ সামরিক অভিযান চালাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশি রাখাইনদের নেতা ক্যাঞিং রাখাইন।
“আরাকানের ৪০ লাখ রাখাইনকে রক্ষার জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতেই” তাঁদের এই সমাবেশ বলে জানান ক্যাঞিং।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি রাখাইনদের এটিই প্রথম কোনো প্রতিবাদ বলেও তিনি জানান।
বাংলাদেশি রাখাইনদের ভাষ্যমতে, আরাকানে চলমান সাম্প্রতিক ঘটনা সম্পর্কে বিশ্ববাসী খুব কমই জানে। আক্রান্ত এলাকাগুলোতে কোনো সাংবাদিক প্রবেশই করতে পারে না। নৃশংসতা গোপন করার জন্য রাখাইন ও চিন রাজ্যে মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেট সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে মিয়ানমার সরকার।
যেসব এলাকায় কিছু কিছু মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে সেসব এলাকা থেকে বাংলাদেশের রাখাইনরা মাঝে মধ্যে তাঁদের খবর পাচ্ছেন জানিয়ে ক্যাঞিং বলেন, “বাংলাদেশের রাখাইন আর আরাকানের রাখাইন একই জাতিগোষ্ঠী। আমাদের প্রায় সবারই সেখানে (রাখাইনে) আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। যাদের মাধ্যমে আমরা সব কিছু জানতে পারি।”
মিয়ানমারের স্থানীয় একটি মানবাধিকার সংস্থার বরাত দিয়ে বাংলাদেশ রাখাইন কালচার গ্রুপের সভাপতি মংখ্যাইহ্রী রাখাইন বেনারকে জানান, আরাকানে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর তাণ্ডবে ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সহস্রাধিক বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে চলতি বছরে মারা গেছেন ২২৪ জন। নিহতদের ৯০ শতাংশ রাখাইন। এছাড়া রোহিঙ্গা, খুমি, খেয়াং ও মুরং জাতিরও অনেকে মারা গেছেন।
“বাস্তুচ্যুত হয়ে দুই লাখ ৬০ হাজার মানুষ এখন পাহাড়ের বনে-জঙ্গলে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছেন,” জানিয়ে তিনি বলেন, “সেখানেও থাকতে না পারলে তাঁদের দেশত্যাগ ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।”
“এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেহেতু কাছে, তারা এখানে আসার কথাই সবার আগে ভাববে,” যোগ করেন তিনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার উইংয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “রাখাইনের পরিস্থিতি আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি। তবে নতুন করে আর কোনো শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়।”
প্রসঙ্গত, সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণ ও নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের চিন রাজ্য থেকে বৌদ্ধ ধর্মালম্বী খুমি, খেয়াং ও রাখাইন সম্প্রদায়ের ১৬০ জন বান্দরবানের রুমা উপজেলার দুর্গম সীমান্ত পথে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে অবশ্য তাঁরা নিজেদের দেশে ফিরে গেছেন।
“মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের বিষয়টি নতুন নয়,” মন্তব্য করে কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “ইতিপূর্বে একই চেষ্টা করা হয়েছে বলে বিভিন্ন স্বীকৃত-অস্বীকৃত জাতিগোষ্ঠী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে যুদ্ধ করছে। বাংলাদেশি রাখাইনরা নিঃসন্দেহে সেখানকার নির্যাতন-নিপীড়নের চেহারা আরও বেশি উন্মোচিত করেছে।”
রাখাইনদের প্রতিবাদ এই প্রথম
আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে ধর্ষণ, গণহত্যাসহ নানা নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন ক্যাঞিং।
মিয়ানমার লাগোয়া জেলা কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ পটুয়াখালী, বরগুনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার সাত শতাধিক রাখাইন এই দিন শাহবাগে জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করে ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড এবং বক্তৃতায় তাঁদের দাবিগুলো তুলে ধরেছেন।
তুনিও রাখাইন বেনারকে বলেন, “মানববন্ধন থেকে আমরা বাংলাদেশি রাখাইনরা মিয়ানমার সরকারের প্রতি গণহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়েছি। একইসঙ্গে জাতিসংঘকে দেশটির ওপর চাপ বাড়াতে অনুরোধ করছি, যাতে তারা রাখাইনে তাদের সামরিক আগ্রাসন থামায়।”
এই কর্মসূচির মুখ্য আয়োজক মংখ্যাইহ্রী রাখাইন বেনারকে জানান, মিয়ানমারের দূতাবাসের সামনে মানবন্ধনটি করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। অনুমতি না পাওয়ার কারণে শাহবাগে করেছেন।
মানববন্ধন থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং এবং দেশটির সর্বোচ্চ বেসামরিক নেতা অং সান সুচি কে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হয়।
বাংলাদেশি রাখাইনদের এই কর্মসূচি ও তাঁদের অভিযোগগুলো সম্পর্কে ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়ের কাছে জানতে চেয়ে মেইল করা হলেও কোনো জবাব পাননি বেনার প্রতিনিধি।
আদিবাসী নেতাদের হিসাবমতে, বাংলাদেশে প্রায় ১৬ হাজার রাখাইন জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।
‘বিদেশি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন গ্রহণযোগ্য নয়’
বর্মীদের অভিযানে ১৭৮৪ সালে দখল হওয়া আরাকানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পুনুরুদ্ধারে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধরত আরাকান আর্মির (এএ) কর্মকাণ্ডের প্রতি সমর্থনের কথা বেনারকে জানিয়েছেন সমাবেশে অংশগ্রহণকারী রাখাইন নেতারা।
গত মার্চে এএ-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে মিয়ানমার সরকার।
আন্দোলনকারী তুনিও রাখাইনের মতে, “এএ আসলে গণমানুষের সংগঠন। সেখানকার জনসাধারণ এই বাহিনীকে সমর্থন করে এবং তাঁদের নিজেদের জীবন ও সম্পদের রক্ষক মনে করে।”
মংখ্যাইহ্রী রাখাইন বলেন, “আমার মতে এএ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। আরাকানে এমন কেউ নেই, যে তাদের বিরুদ্ধে বলতে পারবে।”
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমানের মতে বাংলাদেশি রাখাইনদের আরকান আর্মির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন জানানো গ্রহণযোগ্য নয়।
তাঁর মতে, “আরাকানে তাঁদের ওপর যে গণহত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন হয়েছে, বাংলাদেশের রাখাইনরা তার প্রতিবাদ জানাতেই পারে। এটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, তার মানে সশস্ত্র সংগঠনকে সমর্থন করা যায় না।”
“একটি জাতিগত পরিচয়কে সামনে এনে বাংলাদেশে বসে মিয়ানমারের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করার কথা বলা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী চিন্তাভাবনার প্রকাশ। এর পিছনে নিশ্চয় বিদেশি শক্তি রয়েছে, যারা নতুন করে কোনো ইস্যু তৈরি করতে চাচ্ছে,” বেনারকে বলেন কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেন।
রোহিঙ্গাসহ রাখাইন রাজ্যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন সম্পর্কে বাংলাদেশি রাখাইনরা আগে কোনো ধরনের প্রতিবাদ করেনি জানিয়ে ড. দেলোয়ার বেনারকে বলেন, “সরকারের উচিত তাঁদের বক্তব্যের সত্যতা ও উদ্দেশ্য যাচাই করে দেখা। তাঁদের তৎপরতার পেছনে অন্য কোনো দেশের বা পক্ষের মদদ আছে কিনা, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার।”
বাংলাদেশ আরাকান আর্মির সমর্থকদের সমাবেশকে কেন্দ্র করে মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করার একটি ‘অজুহাত’ খুঁজতে পারে জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান বলেন, “এটা আমাদের জন্য ভালো হবে না।”
কক্সবাজারের টেকনাফের লেদার শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আলম বেনারকে বলেন, “আরাকানি ও মগ হিসেবে পরিচিত রাখাইনদের সাথে রোহিঙ্গাদের সম্পর্ক এক সময় খুব ভালো ছিল। কিন্তু গত শতকের শেষ দশকে তা খারাপ হতে শুরু করে।”
প্রসঙ্গত, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নে ২০১৭ সালের পর প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এর আগে থেকেও বাংলাদেশে বসবাস করছেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, মিয়ানমার সেনাদের সাথে স্থানীয় রাখাইনরাও তাঁদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়েছে।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি ও কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।
সংশোধনী: মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মিকে (এএ) সমর্থনের কথা ব্যক্তিগতভাবে বেনারকে বলেছেন প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী রাখাইন নেতারা। আগের ভার্সনে ভুলবশত প্রতিবাদ সমাবেশে আরাকান আর্মিকে সমর্থনের কথা লেখা হয়েছিল।