রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে তথ্য সংগ্রহ শুরু আগামী সপ্তায়

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.01.03
ঢাকা
উখিয়ার জামতলি রোহিঙ্গা শিবির। উখিয়ার জামতলি রোহিঙ্গা শিবির। ২৭ নভেম্বর ২০১৭।
AP

রাখাইন থেকে প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে তাঁদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তথ্য সংগ্রহ করার জন্য মিয়ানমার সরকারের পাঠানো বিশেষ প্রত্যাবাসন ফরম বাংলাদেশ সরকার হাতে পেয়েছে বলে জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম।

তিনি বুধবার বেনারকে বলেন, আগামী রোববারের পর যে কোনো দিন শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস ওই ফরম অনুসারে শরণার্থীদের নাম, পিতা-মাতার নাম, ঠিকানা, বয়সসহ প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করে তা মিয়ানমার সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে।

প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের জন্য শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনারের নেতৃত্বে নয় সদস্যের একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির তত্ত্বাবধানে শরণার্থীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হবে।

“আমরা মিয়ানমার সরকারের পাঠানো প্রত্যাবাসন ফরম পেয়েছি। আমরা এখনো ফরম অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ শুরু করিনি। আশা করি আগামী সপ্তাহে, রোববারের পর কোনো একদিন আমরা ওই ফরম অনুসারে তথ্য সংগ্রহ কাজ শুরু করতে পারব,” শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বুধবার বেনারকে জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ওই ফরম মিয়ানমারের নাগরিকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে না। শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার অফিস থেকে ওই সকল তথ্য সংগ্রহ করা হবে।

কমিশনার কালাম বলেন, ইতিমধ্যে আমার নেতৃত্বে নয় সদস্যের একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ত্রাণ মন্ত্রণালয়, পরিসংখ্যান বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধি রয়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রবেশ করা সকল রোহিঙ্গা নাগরিকের বায়োমেট্রিক তথ্য সরকারের কাছে আছে। তাই ফরম অনুযায়ী প্রত্যাবাসনে আগ্রহীদের তথ্য সংগ্রহের পর বায়োমেট্রিক তথ্যের সঙ্গে সেগুলো মিলিয়ে মিয়ানমার সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, মিয়ানমার সরকার সেই শরণার্থীদের আবাসস্থল যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশকে জানানোর পর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া তদারকির জন্য বাংলাদেশ-মিয়ানমার জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের আসন্ন সভায় বিস্তারিত আলোচনা করে নির্দিষ্ট দিনে প্রত্যাবাসন শুরু হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ডেস্কের মহাপরিচালক মনজুরুল করিম খান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া রাতারাতি হয় না। এর জন্য একটু সময় প্রয়োজন হয়। আমরা এখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য মিয়ানমারকে জানাব। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে ক্লিয়ারেন্স দিলেই তারা যেতে পারবে।”

২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির সন্ত্রাসী হামলার পর শুরু করা ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের’ পর থেকে ছয় লাখ ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা।

ওই আক্রমণের আগে থেকেই বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মিলিয়ে প্রায় দশ লাখ মিয়ানমার মুসলিম বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

গত বছর ২৩ নভেম্বর দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী, আগামী জানুয়ারি ২২ তারিখের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা।

২৩ নভেম্বরের চুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমার ২০১৬ সালের অক্টোবর ও ২৫ আগস্ট সন্ত্রাসী হামলার পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। চুক্তি অনুযায়ী, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া তদারকি করার জন্য দুই দেশের মধ্যে ৩০ সদস্যের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হয়েছে।

গঠিত হওয়ার পর গ্রুপ এখনো কোনো সভা আয়োজন করেনি।

নয় তারিখে গ্রুপ সভার প্রস্তাব

মিয়ানমার আগামী নয় জানুয়ারি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা করার প্রস্তাব করেছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, কিন্তু আমরা এখনো বলতে পারছি না ওই তারিখে সভাটি করা সম্ভব হবে কি না।

কারণ, ওই তারিখে পররাষ্ট্রসচিব অন্য কিছু কাজে ব্যস্ত থাকতে পারেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, তবে তারিখ নির্ধারিত হবে দুই দেশের সম্মতির ভিত্তিতে।

মহাপরিচালক মনজুরুল করিম খান চৌধুরী বেনারকে বলেন,, “যৌথ গ্রুপের সভা মিয়ানমার অথবা ঢাকা যেকোনো স্থানে হতে পারে। আমরা যদি যেতে না পারি সে ক্ষেত্রে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসবে। আবার তারা আসতে না পারলে আমরা মিয়ানমার যাব।”

“আমরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার পর্যায়ে আছি”, বলেন খান চৌধুরী।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বেনারকে বলেছেন, আশা করা যায় প্রথম ব্যাচের রোহিঙ্গারা আগামী ২২ তারিখের মধ্যে রাখাইন ফিরে যাবে।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বেনারকে বলেন, প্রাথমিকভাবে এক লাখ রোহিঙ্গাদের নামের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মিয়ানমারকে দেবে বাংলাদেশ। যাচাই-বাছাইয়ের পর তাদের পুনর্বাসিত করা হবে।

রোহিঙ্গারা যাবে দিনের বেলা

চলতি মাসের ২২ তারিখে টং পিয়ো এবং না খু ইয়া পয়েন্ট দিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার কথা বেনারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে জানিয়েছেন মিয়ানমার সরকারের কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ে।

তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরে কারফিউ কার্যকর থাকায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কেবলমাত্র দিনের বেলাতেই মিয়ানমারে প্রবেশ করতে পারবে।

সন্ধ্যা ছয়টার পর আর কাউকে রাখাইনে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। এই ব্যবস্থা মানুষের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

আয়ের মতে, মাসের ২২ তারিখে টং পিয়ন এবং না খু ইয়া পয়েন্ট দিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চালু হবে।

এ প্রসঙ্গে শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, “এটা খুব বড় বিষয় হবে না। রাতের বেলাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চালু রাখার কিছু সমস্যা আছে। রাস্তা ভালো নয়। আবার রাতে আমরা কতটা সফলভাবে তাদের পাঠাতে পারব সে ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন আছে।”

তিনি বলেন, “প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করাই বড় কথা; সেটা দিনে বা রাতে যখনই হোক। তবে আমরা বিষয়টি নিয়ে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের আগামী সভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। আমরা জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি”।

উখিয়া থেকে শরণার্থী মোহাম্মদ হাফেজ টেলিফোনে বেনারকে জানান, “আমি তো কোনো সমস্যা দেখি না। বরং দিনে যাওয়া ভালো। রাতে সাপ, পোকামাকড়ের ভয় তো আছেই। রাস্তাঘাট ভালো নয়। রাতে অনেক নারী-শিশু হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।”

আরেক শরণর্থী শাহ আলম (পরিবর্তিত নাম) বেনারকে বলেন, মিয়ানমার সরকার চায় যত কম সংখ্যক রোহিঙ্গাদের প্রবেশ দিতে। “শুধু দিনে ঢুকতে দিলে কম মানুষকে প্রত্যাবসিত করা যাবে। এটা তাদের বিলম্ব করার কৌশল মাত্র”।

তিনি বলেন, ১৯৯৩ সালে তিনি রাতে বাংলাদেশ থেকে রাখাইন রাজ্যে প্রবেশ করেছিলেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।