ভাসানচরের দুশ্চিন্তা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, দ্বীপটিতে গেলেন আরো সাত’শ রোহিঙ্গা
2022.01.07
ঢাকা ও কক্সবাজার

ভাসানচরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা বিষয়ে বাংলাদেশের সাথে জাতিসংঘের চুক্তি স্বাক্ষরের পর দ্বিতীয় দফায় কক্সবাজার থেকে নোয়াখালীর দ্বীপটিতে স্থানান্তর হয়েছেন আরো ৭৫১ শরণার্থী।
কড়া পুলিশি পাহারায় স্থানান্তরিত এই শরণার্থীদের সঙ্গে ভাসানচরে ফেরত গেছেন দ্বীপ থেকে এক মাসের বেশি আগে কক্সবাজারে বেড়াতে আসা ৬৫ রোহিঙ্গাও। পাশাপাশি, ভাসানচরে থাকা আত্মীয় স্বজনদের সাথে সাক্ষাত ও সেখানকার পরিস্থিতি দেখতে একই জাহাজে কক্সবাজার থেকে ভাসানচর গেছে ৫১ রোহিঙ্গার একটি দল।
চুক্তির পর এটি দ্বিতীয় হলেও এ পর্যন্ত কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে রোহিঙ্গা শরণার্থী হস্তান্তর হয়েছে মোট ৯ বার।
বিষটি নিশ্চিত করে শুক্রবার রাতে ভাসানচরে অবস্থানরত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি (সিআইসি) তানভীর আহমদ বেনারকে বলেন, “নবম দফায় উখিয়া থেকে ৭’শ রোহিঙ্গা বৃহস্পতিবার বিকেলে ভাসানচরে এসেছেন। তাঁদের ইতোমধ্যে সেন্টারে তুলে দেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “নতুন করে স্থানান্তরিত হওয়া শরণার্থীদের সাথে একই জাহাজে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে ৫১ জন রোহিঙ্গা ভাসানচরে থাকা তাঁদের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করা ও এখানকার পরিস্থিতি দেখতে এসেছেন, তাঁরা সপ্তাহখানেক পর আবার কক্সবাজারে নিজ নিজ ক্যাম্পে ফিরে যাবেন।”
গত ডিসেম্বরের শুরুতে ভাসানচর থেকে কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়া রোহিঙ্গা দলটিও ফিরে এসেছে জানিয়ে তানভীর বলেন, “তাঁরা সরকারের এ প্রক্রিয়ার প্রতি খুব সন্তোষ প্রকাশ করছেন এবং আমাদেরকে জানিয়েছেন তাঁদের ক্যাম্পে থাকা স্বজনরাও ভাসানচরে আসার বিষয়ে ইতিবাচক চিন্তা ভাবনা করছেন।”
এর আগে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর সাথে সরকারের চুক্তির পর গত বছর ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো ৬‘শ রোহিঙ্গা ভাসানচরে পাড়ি জমান।
“ভাসানচরের আশ্রয় কেন্দ্রে এখন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকের সংখ্যা দাঁড়ালো ১৯ হাজার ৯৬৮ জনে। এরমধ্যে রয়েছেন গত বছর মে মাসে সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে উদ্ধার হওয়া ৩০৬ রোহিঙ্গাও। অপর রোহিঙ্গারা সেখানে স্বেচ্ছায় স্থানান্তরিত হয়েছেন,” বেনারকে বলেন অতিরিক্ত শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামছু-দৌজ্জা।
তিনি বলেন, “এবারে কক্সবাজার ক্যাম্প থেকে মাঝিসহ (রোহিঙ্গা নেতা) ৫১ রোহিঙ্গা ভাসানচর দেখতে গেছেন। তাঁরা সেখানকার পরিস্থিতি ঘুরে দেখে সপ্তাহখানেক পর ফিরবেন।”
এর আগে ভাসানচর থেকে কক্সবাজারে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করতে আসা রোহিঙ্গাদের দলটি ফিরে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভাসানচর ও কক্সবাজারের মধ্যে রোহিঙ্গাদের যাতায়াতের “এ প্রক্রিয়াটি পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখান থেকে ভালো কিছু দেখা গেলে সেটি চলমান থাকবে।”
সরেজমিন দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার সকালে উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গারা উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে সমবেত হন।
একই দিন দুই দফায় ব্যাপক পুলিশি পাহারার মধ্যে দিয়ে তাঁদেরকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয় এবং সেখান থেকে নোয়াখালীর ভাসানচরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে শরণার্থীদের নিয়ে নৌবাহিনীর জাহাজ।
দেশি ও বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরগুলো থেকে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের কার্যক্রম শুরু হয়।
এরপর দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে গত বছরের ৯ অক্টোবর ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সহায়তা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়ার সম্মতি প্রকাশ করে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
জাতিসংঘের সাথে চুক্তি হলেও প্রয়োজনীয় “সুযোগ-সুবিধা” নিশ্চিত না করেই ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর হচ্ছে দাবি করে এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
“চলাচলের স্বাধীনতা ও অন্যান্য অধিকার সুরক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের উচিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভাসানচর দ্বীপে স্থানান্তর বন্ধ রাখা,” বলছে এইচআরডব্লিউ।
ভাসানচরের দুশ্চিন্তা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা
ভাসানচরের ঘর ও নিরাপত্তার কিছু বিষয়ে ভালো দিক দেখলেও রোহিঙ্গারা বলছেন সেখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার মান কক্সবাজারের তুলনায় বেশ খারাপ।
সম্প্রতি ভাসানচর থেকে কক্সবাজারে বেড়াতে আসা একজনের চাচাতো ভাই উখিয়া বালুখালী ক্যাম্পের মো. রফিক।
রফিক তাঁর চাচাতো ভাইয়ের বরাত দিয়ে বেনারকে বলেন, “সেখানে সকল ব্যবস্থাপনা খুব ভালো। সব থেকে ভালো দিক হচ্ছে সেখানে জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হয় না। যেমনটি ক্যাম্পে প্রতিনিয়ত জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের দৌড়তে হয়।”
“কিন্তু ভাসানচরে শিক্ষা কার্যক্রম এবং স্বাস্থ্য সেবা কক্সবাজারের তুলনায় বেশ খারাপ। এই ব্যবস্থাপনাগুলো ভালো হলে হয়তো ভাসানচর রোহিঙ্গাদের জন্য থাকার উপযুক্ত হয়ে উঠবে,” বলেন রফিক।
ভাসানচর দেখতে যাওয়া ৫১ সদস্যের মধ্যে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) এর সদস্য শফি উল্লাহ চর থেকে ফোনে বেনারকে বলেন, “এখানের পরিবেশ বেশ ভালো এবং ঘর-বাড়িগুলো অনেক সুন্দর।”
তিনি বলেন, “প্রথম দিন এখানকার পরিস্থিতি দেখে আমরা সবাই সন্তুষ্ট। কাল আমরা ভাসানচরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্যসেবা দেখব।”
মিয়ানমারের সেনাদের অভিযান থেকে প্রাণে বাঁচতে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাস করছেন। এদের বেশিরভাগই ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নৃশংস অভিযানের সময়ে এসেছিলেন।
কক্সবাজার থেকে শরণার্থীদের চাপ কমাতে দুই বছর আগে অন্তত ১ লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনার দ্বীপ ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেয় সরকার।
গভীর বনে অভিযান চালিয়ে অস্ত্রসহ চার রোহিঙ্গা আটক
শুক্রবার ভোরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্তের মাঝামাঝি গভীর বন এলাকায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্রসহ চার রোহিঙ্গাকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত এই অভিযানে আটককৃত রোহিঙ্গারা “সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে এই অস্ত্রসমূহ অভিনব কায়দায় পরিবহন করছিল” বলে দাবি করা হয় র্যাব-১৫ কক্সবাজারের কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক আবদুস সালাম চৌধুরী স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
আটককৃত চার রোহিঙ্গা হলেন, মোহাম্মদ নুর (৩২), নাজিম উল্লাহ (৩৪), মো. আমান উল্লাহ (২৩) ও খায়রুল আমিন (১৯)।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দুই রোহিঙ্গার কাছ থেকে জ্বালানি কাঠের বোঝায় লুকিয়ে রাখা অবস্থায় একটি স্টেনগান, একটি পিস্তল ও চারটি দেশি তৈরি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
অপর দুই রোহিঙ্গার দেহ তল্লাশি করে আরও দুটি দেশি অস্ত্র পাওয়া যায়। এ ছাড়া তাঁদের কাছ থেকে ৫টি ম্যাগাজিন, ১২টি তাজা গুলি ও ৬টি গুলির খোসা পাওয়া যায়, বলে জানায় র্যাব।
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা শিবিরে জনপ্রিয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ এবং পরবর্তীতে আরো ৬জন খুন হবার পর থেকেই শিবির এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কমাতে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে আসছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো।
গত বছরের ৮ নভেম্বর কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবির সংলগ্ন পাহাড়ে অস্ত্র তৈরি কারখানার সন্ধান পায় র্যাব। ওই অভিযানে বিভিন্ন ধরনের ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।