রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: ২২ জানুয়ারির মধ্যে শুরু নিয়ে অনিশ্চয়তা
2018.01.08
ঢাকা ও কক্সবাজার

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী আগামী ২২ জানুয়ারির মধ্যে প্রথম ব্যাচের রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম বলে বেনারকে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
“প্রত্যাবাসন একটি বিরাট ও জটিল বিষয়। তারিখ দিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সবকিছু করা সম্ভব নয়। তাই আমার মনে হয়, আসছে ২২ জানুয়ারির মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার সম্ভবনা কম,” বেনারকে বলেন শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম।
রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য মিয়ানমারের কাছ থেকে প্রত্যাবাসন ফরম পেলেও সেগুলো এখনো পূরণ করা শুরু হয়নি বলে জানান আবুল কালাম।
তিনি বলেন, “আমরা প্রাথমিকভাবে এক লাখ মিয়ানমার নাগরিকদের সেদেশে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। সেই এক লাখ মানুষের তালিকা মিয়ানমার সরকারকে দিতে হবে। সে জন্য ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টের কাছে থাকা বাংলাদেশে প্রবেশকারী সকল রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক ডেটাগুলোকে বের করে পরিবার অনুযায়ী সাজাতে হবে।”
“একটি পরিবারের সকল সদস্যদের একসঙ্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাই, পরিবার অনুযায়ী তালিকা প্রস্তুত করতে আমাদের আরও সময় প্রয়োজন,” বলেন কমিশনার আবুল কালাম।
প্রত্যাবাসন ফরম পূরণে কমিশনার আবুল কালামের নেতৃত্বে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রাখা হলেও অনেক বিভাগ এখনো ওই কমিটিতে তাদের প্রতিনিধিদের নাম পাঠায়নি বলে জানান কমিশনার কালাম।
“এ কারণে আমরা প্রত্যাবাসীদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করতে পারিনি। তবে আশা করছি খুব সহসাই আমরা তাদের নাম পাব ও চলতি সপ্তাহেই তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ শুরু করতে পারব,” বলেন তিনি।
প্রথম সভা ১৫ জানুয়ারি
রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া তদারকির জন্য গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম সভা আগামী ১৫ জানুয়ারি মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র।
“জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম সভা ১৫ জানুয়ারি মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত হবে বলে দু’দেশ একমত হয়েছে। সভাটি দু-দিনব্যাপী হতে পারে,” বেনারকে বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনুবিভাগের মহাপরিচালক মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরী।
২০১৬ সালের অক্টোবর ও গত বছর আগস্ট মাসের পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য গত ২৩ নভেম্বর নেপিডোতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শক অং সান সু চি’র অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তিন্ত সোয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
ওই চুক্তি অনুসারে, আগামী ২২ জানুয়ারির মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা। পাশাপাশি, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া তদারকি করতে দু’দেশের পররাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে ৩০ সদস্যের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হয়।
ফিরতে রাজি নয় রোহিঙ্গারা
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চললেও নিরাপত্তার অভাবে অনেক রোহিঙ্গাই ফিরে যেতে রাজি নন।
মংডুর হাসুয়াটা গ্রাম থেকে আসা লাল মিয়া বেনারকে বলেন, “শুনেছি রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশ-বার্মা চুক্তি করেছে। কিন্তু আমি ফিরে যাব না। ওরা রোহিঙ্গাদের আরাকানে থাকতে দেবে না।”
জীবনের বাকি দিনগুলো এ দেশেই থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেন ৮০ বছরের এই বৃদ্ধ।
এদিকে রাখাইনের বুথিডং এলাকার সিংডং গ্রাম থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শরণার্থী আব্দুল জলিল (৫০) বেনারকে বলেন, “আমরা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে কিছু শুনিনি।”
“আমি বিশ্বাস করি না, মগেরা আমাদের ঢুকতে দেবে,” বেনারকে বলেন কয়েক মাস ধরে টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে বসবাসকারী জলিল।
“তারা রোহিঙ্গাদের শেষ করে দেওয়ার জন্য বছরের পর বছর ধরে আমাদের ওপর জুলুম করছে। ফিরে গেলে ওরা আমাদের বাঁচতে দেবে না,” বলেন তিনি।
রাখাইনে নির্যাতন অব্যাহত, চলছে অনুপ্রবেশ
রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী এখনো রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ করেছে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)
রোববার সংগঠনটির টুইটার পেজে এক বিবৃতিতে গত ৫ জানুয়ারি রাখাইন রাজ্যের মংডুতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গাড়িতে হামলার দায় স্বীকার করার পাশপাশি সংগঠনটি এই অভিযোগ জানায়।
এতে, রাখাইন রাজ্যে ধর্ষণ, হত্যা, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়াসহ “রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবার জন্য” মিয়ানমার সেনাবাহিনীর “জঘন্য অপরাধ” কর্মকাণ্ড এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়।
গত শুক্রবার রাখাইন রাজ্যের মংডুতে টহলরত সেনাবাহিনীর একটি ট্রাকে আরসার হামলায় ছয়জন সেনা সদস্যসহ অন্তত সাতজন আহত হয়।
এই হামলার দায় স্বীকার করা প্রসঙ্গে আরসা “বার্মার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে” তাঁদের “লড়াই চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই” বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করে।
তাঁরা “আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের আত্মরক্ষার স্বার্থে” এ লড়াই করছে বলেও দাবি করা হয়।
তবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করতেই আরসা এই হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে বলে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়ার কাছে মন্তব্য করেছেন দেশটির স্টেট কাউন্সেলর আং সান সু চির দপ্তরের মহাপরিচালক জ তে।
তিবি বলেন, “মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনা ও তাঁদের পুনর্বাসন কার্যক্রমের উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করতেই আরসা পরিকল্পিতভাবে এই হামলা ঘটিয়েছে।”
আরসাকে মিয়ানমার সরকার "সন্ত্রাসী সংগঠন” হিসেবে ঘোষণা করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা সন্ত্রাসীদের একই প্রক্রিয়ায় জবাব দেবো।”
প্রসঙ্গত, গত বছর ২৪ অগাস্ট মিয়ানমার বাহিনীর ৩০টি পুলিশ ফাঁড়িতে একযোগে হামলা চালায় আরসা। এর প্রতিক্রিয়ার দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে ব্যাপক পীড়নমূলক অভিযান শুরু করে। এর ফলে সাড়ে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
দুর্গত রোহিঙ্গাদের কাছে ত্রাণ সরবরাহের সুযোগ দিতে আরসা গত ১০ সেপ্টেম্বর এককভাবে এক মাসের অস্ত্র বিবরিতর ঘোষণা দিলেও শুক্রবারের আগে পর্যন্ত তাঁদের দিক থেকে আর কোনো আক্রমণের কথা জানা যায়নি।
এদিকে রাখাইন থেকে এখনো নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে বলে জানান টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন সিদ্দিক।
তিনি বেনারকে বলেন, “রাখাইনে এখনো নির্যাতন চলছে বলে জানাচ্ছে রোহিঙ্গারা। আমরা তাদের প্রবেশে বাধা দিচ্ছি না।”
প্রায় ২০ জনের দলসহ টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে রোববার বাংলাদেশে প্রবেশ করেন রাখাইনের বুথিডংয়ের বাসিন্দা তৈয়বা খাতুন (৩৫)। তিনি বেনারকে বলেন, “মগেরা এখনো রোহিঙ্গাদের ওপর জুলুম করছে। তাই, আমরা এখানে পালিয়ে এসেছি।”
“ওরা আমাদের বের করে দিতে চায়, ধ্বংস করে দিতে চায়,” বলেন তৈয়বা।