রোহিঙ্গাদের জন্য পুলিশের বিশেষ ব্যাটালিয়ন গঠনের প্রস্তাব
2018.01.09
ঢাকা

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর নজরদারি বাড়াতে ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে একটি বিশেষ ব্যাটালিয়ন গঠনের প্রস্তাব করেছে কক্সবাজার জেলা পুলিশ।
কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরোজুল হক টুটুল বেনারকে জানান, তাঁরা কয়েক সপ্তাহ আগে প্রস্তাবটি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠিয়েছেন। সেখান থেকে সরকারের উচ্চ মহলে গেছে প্রস্তাবটি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেছেন, “প্রস্তাবটি বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের ‘পুলিশিং’ করার জন্য কয়েক’শ বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েন করবে সরকার। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।”
“তারা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ অথবা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের জন্য জাতীয় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে,” মন্তব্য করেন মন্ত্রী।
কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার টুটুল বেনারকে জানান, “কক্সবাজারের স্থানীয় পাঁচ লাখ মানুষের বিপরীতে সেখানে এখন বাড়তি দশ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আশ্রয় নিয়েছে। অথচ পুলিশের সংখ্যা একই রয়েছে। জেলা পুলিশের পক্ষে এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব।”
“তাই আমরা রোহিঙ্গাদের পুলিশিং করার জন্য একটি আলাদা বিশেষায়িত পুলিশ ব্যাটালিয়ন গঠনের প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এই ব্যাটালিয়ন গঠিত হলে আমরা সঠিকভাবে রোহিঙ্গাদের কার্যকলাপের ওপর বিশেষ নজর রাখতে পারব,” বলেন টুটুল।
তিনি বলেন, এই বিপুল দরিদ্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজসহ কেউ কেউ মানব-পাচার, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদকের দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। একটি বিশেষায়িত পুলিশ ব্যাটালিয়ন থাকলে তা তাঁদের রক্ষায় সহায়তা করবে।
কত সংখ্যক পুলিশ থাকতে পারে প্রস্তাবিত বিশেষায়িত পুলিশ ব্যাটালিয়নে এমন প্রশ্নের জবাবে টুটুল বেনারকে বলেন, “সাধারণত একটি ব্যাটালিয়নে ৮০০ থেকে এক হাজার পুলিশ সদস্য থাকে। এক হাজার পুলিশ হলে আমাদের জন্য সুবিধা।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য মারাত্মক রকমের নিরাপত্তা ও জাতীয় হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। এ কথা বিবেচনা করে আমরা কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপারের অধীনে বেশ বড় সংখ্যক বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করব। তারা শুধু রোহিঙ্গাদের পুলিশিং করবে।”
বিশেষায়িত পুলিশ বাহিনী থাকলে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মানব-পাচার, মাদক চোরাচালানসহ অন্যান্য অপকর্মে জড়িত হওয়া থেকে বহুলাংশে বিরত রাখা যাবে।
রাখাইন রাজ্যে ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর সন্ত্রাসী হামলার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী সেখানে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরু করে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারা অবস্থান করছে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে।
রাখাইনে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইন ও নিরাপত্তা বাহিনীর ‘জুলুম’ থেকে বাঁচতে বিভিন্ন সময়ে আরও তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে অবস্থান করছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে এবং তাদের প্রবেশ এখনো অব্যাহত রয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, শরণার্থীরা শিবিরের বাইরে যেতে পারে না। কিন্তু রোহিঙ্গারা সারা দেশে বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন জেলায় রোহিঙ্গারা ধরা পড়ছে। আবার কয়েক মাস আগে কক্সবাজারে তাঁদের স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। রোহিঙ্গাদের কিছু গ্রুপ পুলিশ সদস্যদের আক্রমণ করেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “দেখুন রোহিঙ্গারা নির্যাতিত ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। তাদের মধ্যে শিক্ষার হার খুবই কম। এরা বাঁচার জন্য ডেসপারেট। সুতরাং, খুব সামান্য পরিমাণ অর্থ ও সুবিধার বিনিময়ে এদের বিভিন্ন অপরাধের কাজে ব্যবহার করা খুব সহজ।”
“কিছু কিছু গোষ্ঠী তাদের সন্ত্রাসী কাজে লাগানোর জন্য চেষ্টা করছে। সুতরাং, তাদের ওপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ নজর থাকা প্রয়োজন। সবচে বেশি প্রয়োজন ইনটেলিজেন্স কাজ,” বলেন সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, তবে আমাদের উচিত হবে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো।
লেদা শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জলিল মিয়া টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “আমাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য আমরা বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞ। আরাকানে পরিস্থিতি ভালো হলে আমরা রোহিঙ্গারা একদিন আমাদের দেশে ফিরে যাব। আমরা এদেশের বা বার্মার কোনো ক্ষতি করতে চাই না।”
তিনি বলেন, আমাদের জন্য বাড়তি পুলিশ দরকার কি না জানি না। তবে আমরা বাংলাদেশের পুলিশকে সাহায্য করতে চাই, যেন আমাদের মধ্যে কেউ সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ বা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে বাংলাদেশের বা বার্মার (মিয়ানমারের) কোনো ক্ষতি করতে না পারে।
আরেক রোহিঙ্গা তাহমিনা বেগম টেলিফোনে বেনারকে বলেন, মুষ্টিমেয় কিছু খারাপ লোকের জন্য পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা ঠিক নয়। আরসা নামক গুটিকতক মানুষের জন্য পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আজ দেশ ছেড়ে উদ্বাস্তু।