সহিংসতার স্মৃতি ভুলে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা শিশুরা

সুনীল বড়ুয়া
2019.01.10
কক্সবাজার
190110_Rohingya_CSF_1000.jpg উখিয়ার একটি শিশুবান্ধব কেন্দ্রে রোহিঙ্গা শিশুরা। ২ জানুয়ারি ২০১৯।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

কারো মা নেই, কারো বাবা নেই, আবার কারো কারো মা-বাবা কেউই নেই। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারে যখন রোহিঙ্গা নিধন চলছিল, তখন আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী বা পরিচিতজনের হাত ধরে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল এ রকম প্রায় ৪০ হাজার শিশু।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের মতে মানসিকভাবে ‘দারুণ বিপর্যস্ত’ এসব শিশু মাত্র ১৫ মাসের ব্যবধানে সেইসব দুঃসহ যন্ত্রণার স্মৃতি ভুলে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

সরেজমিনে কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর কয়েকটি শিশুবান্ধব কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, বিপর্যস্ত সেই শিশুরাই এখন প্রাণ খুলে গান গাইছে, ছবি আঁকছে, পড়াশোনা করছে বা খেলাধুলায় মেতে আছে।

উখিয়ার ময়নারঘোনায় ব্র্যাক পরিচালিত একটি শিশুবান্ধব কেন্দ্রে সমবয়সী বন্ধুদের সাথে খেলছিল পাঁচ বছর বয়সের মিনারা বেগম। মুখভরা হাসি দিয়ে সে জানায়, “এখন আমি দোলনায় চড়ি, কেরাম খেলি, ঘর বানাই। এখানে আসলে আমার ভালো লাগে।”

বাবা-মা ছাড়াই বাংলাদেশে আসা মিনারা জানায়, “বার্মার সেনারা আমার বাবা-মাকে কোথায় যেন তাড়িয়ে দিয়েছে। সেজন্য আমি এখানে চলে এসেছি।”

“প্রথম দিকে কেন্দ্রে আসলেও ভালো লাগত না,” মন্তব্য করে দশ বছর বয়সী খোরশেদ বেনারকে বলে, “এখন ভালো লাগে।”

“শিশুবান্ধব কেন্দ্রগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ অব্যাহত রাখার কারণে শিশুরা মানসিক বিপর্যস্থতা কতটা কাটিয়ে উঠেছে তা এখন তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখলেই বোঝা যায়,” বেনারকে বলেন জাতিসংঘের ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) সমন্বয় কর্মকর্তা সৈকত বিশ্বাস।

আইএসসিজির তথ্যানুযায়ী, উখিয়া ও টেকনাফের ৪৬৪টি শিশুবান্ধব কেন্দ্রে গত মার্চ থেকে ১০ ডিসেম্বর অবধি দুই লাখ ৯২ হাজার ৮১৭ জন রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরকে মানসিক সহায়তাসহ নানাবিধ সুরক্ষা পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে দুই হাজার ৬৯৭টি লার্নিং সেন্টার (শিক্ষা কেন্দ্র) থেকেও সেবা পাচ্ছে তারা।

শিশুবান্ধব কেন্দ্রে সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত শিশুরা নানান ধরনের বিনোদনের মাধ্যমে সময় কাটায়। আর শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে তাদেরকে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়া হয় বলে জানান সৈকত।

কমছে মানসিক ক্ষত

ব্র্যাকের চাইল্ড প্রোটেকশান টিমের (ইমার্জেন্সি) সিনিয়র সেক্টর স্পেশালিস্ট বিবেক কান্তি দাশ বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার থেকে যেসব শিশু মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বাংলাদেশে এসেছে, সেইসব শিশুর মনের ক্ষত দূর করার উপযুক্ত স্থান এই কেন্দ্রগুলো।”

“মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিশুদের পাশাপাশি যে কোনো রোহিঙ্গা শিশু সেখানে যেতে পারে,” যোগ করে তিনি জানান, “যেসব শিশুর ভয় কেটে গেছে, তারা শিক্ষা কেন্দ্রেও যাচ্ছে।”

এ পর্যন্ত কতজন শিশু মানসিক বিপর্যস্ততা কাটিয়ে শিক্ষা কেন্দ্রে গেছে তার পরিসংখ্যান না থাকলেও বিবেক জানান, শিশুবান্ধব কেন্দ্রের ৫ বছর বা তার বেশি বয়সের বেশিরভাগ শিশুই এখন শিক্ষাকেন্দ্রে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, শিশুদের কাউন্সেলিং এর জন্য প্রত্যেক সিএসএফ-এর অধীনে সাইকো স্যোশাল কাউন্সিলর রয়েছেন। তাঁরাই শিশুদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন মূল্যায়নের কাজ করে থাকেন।

সৈকত জানান, শিশুদের কোনোভাবেই পরিবার থেকে আলাদা রাখা হয় না, এতে শিশুর সমস্যা আরো বাড়ে।

তিনি বলেন, যেসব শিশুর বাবা-মা কেউ নেই তাদেরকে আত্মীয়স্বজন বা অন্য কোনো পরিবারের সাথে রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে ওই শিশুকে দেখাশোনার জন্য ওই পরিবারটির কোনো সহায়তা প্রয়োজন হলে তাও দেওয়া হয়।

“শিশুবান্ধব কেন্দ্রগুলো এখন রোহিঙ্গা শিশুদের স্বর্গরাজ্য,” বেনারের কাছে মন্তব্য করেন ইউনিসেফের জনসংযোগ কর্মকর্তা নাজ্জিনা মহসিন।

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ব্র্যাক ২৪২টি ও ইউনিসেফ ৭৩টি শিশুবান্ধব কেন্দ্র পরিচালনা করছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

স্বাভাবিক হয়ে উঠছে শিশুরা

মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিশুদের মনের ভয় দূর করতে নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন শিক্ষকেরা।

প্রায় এক বছর ধরে শিশুবান্ধব কেন্দ্রে শিক্ষকতা করছেন মুর্তজা হানিফ। বেনারকে তিনি বলেন, “প্রথম যখন কাজ শুরু করি তখন শিশুদের মধ্যে এক ধরনের ভয় আর মানসিক চাপ লক্ষ করতাম। সবাই মুখ গোমড়া করে থাকত। স্বতষ্ফূর্তভাবে অন্যদের সাথে মিশতে চাইত না।”

“সবার মেজাজই ছিল চড়া। ঝগড়া করত, মিলেমিশে খেলত না। কিন্তু এখন সেই অবস্থা কাটিয়ে তারা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। সবার ভয়ও মোটামুটি কেটে গেছে,” বলেন তিনি।

আরেক শিক্ষক শান্তি বড়ুয়া বেনারকে বলেন, “এখানে আমরা সব সময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিশুদের মনের ভয় দূর করার চেষ্টা করি।”

শিক্ষকরা জানান, শিশুবান্ধব কেন্দ্রে দুই থেকে পাঁচ বছর, ছয় থেকে চৌদ্দ বছর এবং ১৪ থেকে ১৮ বছর, বয়স ভেদে মূলত এই তিন ভাগে সকাল নয়টা থেকে ১১টা, সাড়ে ১১টা থেকে দেড়টা এবং দুইটা থেকে চারটা পর্যন্ত বৈঠক করা হয়।

দেওয়া হচ্ছে অর্থ সহায়তাও

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বেনারকে বলেন, “সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে এই শিশুদের দেখভাল করছে বাংলাদেশ সরকার। তাদের ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট আন্তরিক।”

মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ৪০ হাজার শিশুর তালিকা তৈরির কথা জানিয়ে কক্সবাজার জেলা সমাজসেবা অধিপ্তরের উপ-পরিচালক প্রীতম কুমার চৌধুরী বেনারকে বলেন, “ইউনিসেফের সহযোগিতায় এই শিশুদের আর্থিক সহায়তাদানের একটা কর্মসূচি চলমান রয়েছে।”

“অবস্থা বুঝে প্রতিমাসে দুই হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার শিশুকে এ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে নয় হাজার শিশুকে এই কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা হবে।

প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে কক্সবাজারে অবস্থানকারী প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর ৫৫ ভাগই শিশু।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে শরীফ খিয়াম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।