আইন অমান্য করেই চলছে রোহিঙ্গা-বাংলাদেশি বিয়ে
2018.01.15
ঢাকা ও কক্সবাজার
আইনি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে স্থানীয় বাংলাদেশিরা। এমনকি রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই চলছে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা।
রোহিঙ্গা নাগরিকদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে না জড়ানোর নির্দেশ দিয়ে গত বছরের ২৫ অক্টোবর বিবাহ নিবন্ধন সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। ২০১১ সালেও একই বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল।
তা সত্ত্বেও এ ধরনের বিয়ে হচ্ছে। গত তিন মাসে ৭০টিরও বেশি রোহিঙ্গা-বাংলাদেশির বিয়ের খবর দিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা নেতারা। তাঁদের মতে, বেশির ভাগ রোহিঙ্গাই বাল্য বিয়ের শিকার। আর শুধু অভাবের তাড়না আর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেতেই এসব বিয়ে হচ্ছে।
যদিও স্থানীয় প্রশাসন এসব বিয়ের খবর আনুষ্ঠানিকভাবে জানে না। এ ধরনের বিয়ে ঠেকাতে প্রশাসনের তৎপরতাও খুব একটা দৃশ্যমান নয়।
টেকনাফ হ্নীলা ইউনিয়নের পরিষদের ইউপি সদস্য মো.আলী বেনারকে বলেন, “শুধু টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত শিবিরেই গত তিন মাসে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫টি রোহিঙ্গা-বাংলাদেশি বিয়ের ঘটনা ঘটেছে। গোপনে এসব বিয়ে হয় বলে তাদের আইনের আওতায় আনা যায় না। প্রচলিত নিয়মে এসব বিয়ে নিবন্ধনও করা হয় না।”
রোহিঙ্গা-বাংলাদেশির বিয়ের বিষয়টি স্বীকার করেন এই শিবিরের মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) মো. আবদুল মতলব।
এসব বিয়ের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা বজায় রাখা হয় জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “আশ্রয় মিললেও রোহিঙ্গারা থাকা-খাওয়ার সংকটে রয়েছে। নিরাপত্তা সংকট আরও বেশি। এমন অবস্থায় মেয়েদের বিয়ে দিয়ে ভার কমাতে চায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা।”
“আর পাত্র বা পাত্রীর ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশি। এতে করে এদেশের নাগরিক হওয়ার সুযোগ কিছুটা সহজ হয়,” জানান মতলব। পুরনো রোহিঙ্গা শরণার্থী কিংবা নতুন আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যেও বিয়ে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
গত তিন মাসে টেকনাফের জাদিমুড়া ও হোয়াইক্যং পুতিন পাহাড়ের রোহিঙ্গা বস্তিতে ২০টি এবং উনচিপ্রাং বস্তিতে পাঁচটি বাংলাদেশি-রোহিঙ্গা বিয়ের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন এসব শিবিরের নেতারা।
জাদিমুড়া রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মো. একরাম বেনারকে বলেন, “তিন মাস ধরে এই রোহিঙ্গা শিবিরে দায়িত্ব পালন করছি। আমার জানা মতে, এখানে মাঝেমধ্যে রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে স্থানীয় বাঙালি ছেলেদের বিয়ে হচ্ছে। তবে ছেলেদের কাউকে আমি চিনি না। রোহিঙ্গা নারীদের পরিবার বিষয়টি আমাকে অবহিত করলেও গোপন রাখার অনুরোধ জানিয়েছে।”
হোয়াইক্যং পুতিন পাহাড়ে রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মো. রশিদ বেনারকে জানান, এই শিবিরে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে ১০–১২ জন রোহিঙ্গা নারীর বিয়ে হয়েছে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে।
তবে রোহিঙ্গা-বাংলাদেশির বিয়ে সম্পর্কে প্রশাসন অবগত নয় বলে বেনারকে জানান টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক।
“শরণার্থী শিবিরগুলোতে বাল্য বিবাহ ও বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রম ঠেকাতে পুলিশ চেষ্টা করছে। কোনও বাংলাদেশি যাতে রোহিঙ্গা বিয়ে করতে না পারে, সে বিষয়ে নজর রাখা হয়েছে,” জানান ইউএনও।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বেনারকে বলেন, “পুলিশকে বাংলাদেশি-রোহিঙ্গা বিয়ের তালিকা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিয়েতে আমাদের আপত্তি নেই।”
দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারে অবস্থান করে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান। তিনি বেনারকে বলেন, প্রশাসনের কড়াকড়ি সত্ত্বেও প্রচুর বাংলাদেশি রোহিঙ্গাদের বিয়ে করছে। বিষয়টি উদ্বেগের। তবে মূলতঃ নিরাপত্তার কারণেই তারা বিয়ে করছে।”
রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই বিয়ে
আইনি জটিলতা এড়াতে রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই চলছে রোহিঙ্গা বিয়ে করার আনুষ্ঠানিকতা। স্থানীয় লোকজনের উপস্থিতিতেই বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গত ১৯ ডিসেম্বর রোহিঙ্গা কিশোরী উম্মে জমিনাকে (১৪) বিয়ে করেছেন টেকনাফের জাদিমুরা গ্রামের মো. শাকের (৩০)।
পেশায় জেলে শাকের বেনারকে বলেন, “গত দুই মাস আগে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের অনিবন্ধনকৃত শিবিরে উম্মে জমিনার সঙ্গে দেখা হয়। এরপর খোঁজখবর নিয়ে তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই।”
বাড়িতে মৌলভী ডেকে এনে একটা স্ট্যাম্পে সই করে বিয়ে করেছেন শাকের। দেনমোহর হিসেবে একভরি সোনা দেওয়ার অঙ্গিকার করেছেন।
আইনের প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বলেন, “সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণেই আমরা কাজী অফিস বা আদালতে গিয়ে বিয়ে করতে পারিনি। কাবিননামাও করা হয়নি।”
নতুন কনে উম্মে জমিনা বেনারকে বলেন, “গত আগস্ট মাসে রাখাইনে নিজের চোখের সামনেই মিয়ানমার সেনাদের গুলিতে বাবা–মা মারা যান। এক চাচার সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে আসি। কিন্তু এখানে চাচার পক্ষে আমার ভরণপোষণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে বিয়ে দিয়েছেন।”
টেকনাফের নয়াপাড়া নিবন্ধনকৃত শরণার্থী শিবিরের উল্টোদিকের দক্ষিণ লেদা গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা বদিউল আলমের বাড়ি। দিনমজুর বদিউল আলম ক্যাম্পে যাওয়া আসার সুযোগে রোহিঙ্গা শরণার্থী শামসুন্নাহারের প্রেমে পড়েছিলেন। গত ২০ অক্টোবর তিনিও গোপনে শামসুন্নাহারকে বিয়ে করেন।
গত নভেম্বর মাসের শেষের দিকে মো. আনোয়ার হোসেন নামে স্থানীয় যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয় রোহিঙ্গা কিশোরী নুর কলিমার (১৩)। মিয়ানমার সেনাদের হাতে তার বাবা–মা খুন হয়। এরপর দুই ভাইকে নিয়ে চাচা নুর হাফেজের সঙ্গে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে জাদিমুড়া রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেয় এই কিশোরী।
মংডুর রাইম্ম্যালি গ্রামের বাসিন্দা নূর হাফেজ বেনারকে বলেন, “সংসারের ভার বহন করতে হিমশিম খাচ্ছি। তাই স্থানীয় ছেলে দেখে মেয়েটার বিয়ে দিয়েছি। গোপনে এক মৌলভীর মাধ্যমে বিয়ে দিতে হয়েছে।”
একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গাদের বেছে নিচ্ছে বাংলাদেশিরা। দুই মাস আগে শামসুন্নাহার নামে এক রোহিঙ্গা নারীকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে বিয়ে করেন টেকনাফের হোয়াইক্যং মধুছড়ি গ্রামের জাকির হোসেন। দুই সন্তানসহ প্রথম স্ত্রীকে স্বজনদের কাছে রেখে রোহিঙ্গা শিবিরেই বাস করছেন জাকির।
তিনি বেনারকে বলেন, “দেশে হিন্দু–মুসলিম বিয়ে হচ্ছে, সেখানে আমি মুসলমান হয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমকে বিয়ে করলে আপত্তি কোথায়?”
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের মসজিদে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইমামতি করেন মৌলভী মো. হারুন। তিনি নিজে রোহিঙ্গা-বাংলাদেশিদের মধ্যে দুইটি বিয়ে পড়ানোর কথা বেনারের কাছে স্বীকার করেন।
তবে টেকনাফ উপজেলার বিয়ে নিবন্ধনকারী কাজী রাকেবুল হক বেনারকে বলেন, “নিবন্ধন আইনে পরিচয় পত্র এবং জন্ম নিবন্ধন থাকাসহ নানান শর্তের কারণে রোহিঙ্গাদের বিয়ে গোপনে হচ্ছে এবং এর কোনো হিসাব থাকছে না।”
তাঁর মতে, “প্রশাসন যদি মাঠপর্যায়ে আরও সক্রিয় হয় তাহলে বাংলাদেশিদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিয়ে করার প্রবণতা কমে আসবে।”
রোহিঙ্গা বিয়ে করে বিপাকে
আইন অমান্য করে মিয়ানমার থেকে আসা এক রোহিঙ্গা তরুণীকে বিয়ে করে বিপাকে পড়েছে বরসহ মানিকগঞ্জের একটি পরিবার। রোহিঙ্গা বিয়ের ঘটনায় পুলিশ মানিকগঞ্জের সিংগাইরের চারিগ্রামের শোয়াইব হোসেন জুয়েলকে খুঁজছিল। পূত্রের গ্রেপ্তার ও হয়রানি বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন তার বাবা বাবুল হোসেন।
কিন্তু আইন অমান্য করে বিয়ে করায় গত ৯ জানুয়ারি রিটটি খারিজের পাশাপাশি বাবুল হোসেনকেই এক লাখ টাকা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। জরিমানা না বলে এটাকে বলা হয়েছে মামলার খরচা। আগামী ৩০ দিনের মধ্যে রিটকারীকে এই টাকা আদালতের সংশ্নিষ্ট শাখায় জমা দিতে হবে। অন্যথায় তাঁর বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে আদালত বর-কনের বিষয়ে আলাদা করে কোনো নির্দেশনা দেয়নি।