রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে মিয়ানমার যাচ্ছেন পররাষ্ট্র সচিব

কামরান রেজা চৌধুরী ও তুষার তুহিন
2018.01.12
ঢাকা ও কক্সবাজার
উখিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছে রোহিঙ্গারা। উখিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছে রোহিঙ্গারা। ১২ জানুয়ারি ২০১৮।
AFP

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন শুরু হবার কোনো তারিখ এখন পর্যন্ত নির্ধারিত না হলেও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি চূড়ান্ত করতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল শনিবার ঢাকা ছাড়ছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনুবিভাগের মহাপরিচালক মনজুরুল করিম খান চৌধুরী শুক্রবার বেনারকে বলেন, “জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম সভা আগামী ১৫ জানুয়ারি শুরু হয়ে শেষ হবে পর দিন। পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে আমরা আগামীকাল শনিবার ব্যাংকক হয়ে নেপিদো যাচ্ছি।”

দুদিনব্যাপী বাংলাদেশ-মিয়ানমার জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম সভায় প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্ততি নির্ধারণ করা হবে বলেও জানান তিনি।

সভায় প্রত্যাবাসনের আগে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বসবাসের সুবিধাসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে আলোচনা করবেন দুই দেশের কর্মকর্তারা।

গত বছর ২৩ নভেম্বর স্বাক্ষরিত রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ২২ জানুয়ারির মধ্যে প্রথম ব্যাচের শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন করার কথা রয়েছে।

তবে “চুক্তি অনুযায়ী ২২ জানুয়ারির মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরুর কোনো সুযোগ দেখি না,” বলে মন্তব্য করেন মনজুরুল করিম খান।

৩০ সদস্যের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ পুরো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নির্ধারণ ও তদারক করবে। গ্রুপে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ১৫জন করে সদস্য রয়েছেন।

এদিকে মিয়ানমারের অধিবাসী হিসেবে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার জন্য প্রথম পর্যায়ে এক লাখ সম্ভাব্য প্রত্যাবাসীদের তালিকা প্রস্তুত করে সে দেশের সরকারের হাতে দেওয়ার কথা। সেই তালিকা এখনো প্রস্তুত করা সম্ভব হয়নি বলে জানান জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য ও মহাপরিচালক চৌধুরী।

প্রস্তাবিত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পর্কে মনজুরুল করিম খান চৌধুরী বলেন, প্রত্যাবাসনের প্রথম ধাপ হিসেবে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন বিভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর তৈরি করা ডেটাবেস থেকে এক লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমার সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ওই তালিকা অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করে দেখবে যে, তারা রাখাইনের বাসিন্দা ছিল কি না। যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে শনাক্ত করা ব্যক্তিদের সম্ভাব্য প্রত্যাবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।

এরপর ওইসব ব্যক্তি মিয়ানমারে ফিরতে আগ্রহী কি না তা জানতে চাওয়া হবে। আগ্রহী হলে মিয়ানমার সরকারের দেওয়া প্রত্যাবাসন ফরম পূরণ করে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এরপর নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট পয়েন্ট দিয়ে তারা রাখাইনে প্রবেশ করবে।

এখন পর্যন্ত তালিকা না হবার কারণ সম্পর্কে মনজুরুল করিম খান বেনারকে বলেন, “আমাদের কাছে সকল শরণার্থীর তথ্য আছে। তবে ওই তালিকা পরিবারভিত্তিক হতে হবে। তাই তালিকা প্রস্তুত করতে সময় লাগছে।”

আমরা জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম সভায় বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব,” বলেন তিনি।

মহাপরিচালক বলেন, চুক্তি অনুযায়ী জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থাকে প্রত্যাবাসনের সঙ্গে জড়িত করা হবে। তবে কখন করা হবে, এ ব্যাপারে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার ঢাকা অফিসের কমিউনিকেশন অফিসার জোসেফ ত্রিপুরা বেনারকে বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের এখন পর্যন্ত কোনও প্রস্তাব দেওয়া হয়নি।”

এদিকে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বেনারকে বলেন, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ডেটা সংগ্রহের জন্য যে ফরম পাঠিয়েছে তাতে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে।

“জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় মিয়ানমার সরকারের দেওয়া প্রত্যাবাসন ফরমের অসঙ্গতি নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে,” বলেন কালাম।

তিনি বলেন, “সেই ফরমে জাতীয়তা প্রসঙ্গসহ কয়েকটি শব্দ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা কী হবে, তা নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।”

ফরম চূড়ান্ত হলেই ডেটা সংগ্রহের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান প্রত্যাবাসন কমিশনার।

এখনো প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার ঢাকা অফিসের কমিউনিকেশন অফিসার জোসেফ ত্রিপুরা বেনারকে বলেন, “সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২৫ আগস্টের পর থেকে ৬ লাখ ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে আমাদের কাছে তথ্য আছে যে, রোহিঙ্গারা এখনও বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বেনারকে বলেন, “এক সপ্তাহ ধরে রোহিঙ্গারা আবারও এ দেশে প্রবেশ করছে। এই সময়ে উখিয়া, টেকনাফ ও বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে।”

এদিকে মিয়ানমারের কর্মকর্তারা বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি-এশিয়াকে বুধবার জানিয়েছেন যে, মিয়ানমার সরকার পাঁচ হাজার রোহিঙ্গার জন্য ঘরবাড়ি তৈরি করেছে এবং বাংলাদেশের কাছ থেকে একটি সম্ভাব্য তালিকা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।

একই দিনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো গত সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য মংডুতে “সন্ত্রাসীদের” (রোহিঙ্গাদের) হত্যা করে কবর দেবার ঘটনা স্বীকার করা হয়েছে।

“আমরা মিলিটারি ও মগদের জুলুমের কথা ভুলব না। যে দেশে বিনা অপরাধে শুধু রোহিঙ্গা হওয়ার জন্য আমার বাবা-মা ও ভাইকে হত্যা করা হয়েছে সেই দেশে আমি যাই কীভাবে?”- বেনারকে বলেন উখিয়ায় শরণার্থী হিসেবে বসবাসরত রোহিঙ্গা মোহাম্মদ আলম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।