শুধু নতুন আর 'যাচাইকৃত' রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি মিয়ানমার

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2017.01.13
টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া দুটি শিশু। টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া দুটি শিশু। ডিসেম্বর ২১, ২০১৬।
স্টার মেইল

বাংলাদেশে সম্প্রতি অনুপ্রবেশ করা ৬৫ হাজার রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার প্রমাণ যাচাই–বাছাইয়ের মাধ্যমে তাদের ফেরত নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে মিয়ানমার। বাংলাদেশে তিন দিনের সফরে এসে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির বিশেষ দূত ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিয়াউ তিন এ প্রস্তাব দেন।

তবে বাংলাদেশ এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে গত কয়েক দশকে আসা মিয়ানমারের সব নাগরিককে ফেরত নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। এ সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ৬৫ হাজার বলে দেশটিকে জানানো হয়।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া তিন লাখ ৬৫ হাজার রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব আন্তর্জাতিক কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাইয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে বাংলাদেশ।

এ ছাড়া শুধু নিজ নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়া নয়, রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতেও মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সমন্বিত ও সামগ্রিক কর্মপন্থা নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আর তাতে সম্মত হয়ে শিগগির আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

মিয়ানমারের দূত সফর নিয়ে বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমের সামনে কথা বলেননি। গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, “মিয়ানমার এ নিয়ে পরবর্তী আলোচনায় সম্মত হয়েছে। তাদের আন্তরিকতায় আমরা আশাবাদী।”

গত ১০ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত মিয়ানমারের দূতের এ সফরকে দেশটির অবস্থানের ইতিবাচক পরিবর্তন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তবে সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রুতি নয়, এর ফল দেখতে চান তাঁরা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “অতি সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকার যে ধরনের অনমনীয় আচরণ দেখিয়েছিল, অন্তত সু চির দূতের এ সফরের মাধ্যমে সে অবস্থানে পরিবর্তন ঘটেছে। কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে এটা একটি শুভ সূচনা বা প্রাথমিক পদক্ষেপ।”

মিয়ানমারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে কিছুটা আশাবাদী হয়ে তিনি বলেন, “সমস্যাটি সমাধানের ক্ষেত্রে দুই দেশকে আরও অনেক কাজ হয়তো করতে হবে। সেই হিসেবে এটাকে সঠিক পদক্ষেপ বলা যায়।”

তবে সাবেক রাষ্ট্রদূত হ‌ুমায়ূন কবীর এ বিষয়ে বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের আগ্রহটা অত্যন্ত ভালো কথা। তবে এই আলোচনা গত কয়েক দশক ধরে চলছে। তাই এই রাজি হওয়াটাকে ফলাফলের আলোকে মূল্যায়ন করতে চাই।”

কক্সবাজারের লেদা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা পরিবার। ডিসেম্বর ২১, ২০১৬।
কক্সবাজারের লেদা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা পরিবার। ডিসেম্বর ২১, ২০১৬।
স্টার মেইল
গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর নিরাপত্তা চৌকিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর ওই অঞ্চলে অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তাদের হত্যা ও নির্যাতন থেকে প্রাণে বাঁচতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ আলোচনা করতে চাইলেও সাড়া দেয়নি দেশটি।

পরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমালোচনা বেড়ে গেলে আলোচনার জন্য দেশটির নেত্রী অং সান সু চি তাঁর শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কিয়াউ তিনকে বাংলাদেশে পাঠান। তিন দিনের সফরে তিনি পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, “বাংলাদেশ নিবন্ধিত শরণার্থী, অনিবন্ধিত এবং নতুন আগত মিয়ানমার নাগরিকদের ফেরত নেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে।”

রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার পাশাপাশি রাখাইন রাজ্যে স্থায়ী শান্তি ফেরাতেও দেশটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রাজ্যটিতে নিরাপত্তা ও টেকসই জীবিকার সুযোগ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

মিয়ানমারের দূত বাংলাদেশের প্রস্তাবগুলো নিজ দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে তুলে ধরার আশ্বাস দিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

সন্ত্রাস দমনে সহায়তা চায় মিয়ানমার

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, তিন দিনের সফরে রাখাইন রাজ্যের ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সশস্ত্র চরমপন্থা বিকাশের সম্ভাবনা উল্লেখ করে মিয়ানমারের বিশেষ দূত ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সশস্ত্র চরমপন্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সহযোগিতা চেয়েছে। এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিতে বাংলাদেশ প্রস্তুত বলে জানিয়েছে।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জিরো টলারেন্স নীতির উল্লেখ করে ইতিপূর্বে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অভিযানের কথা স্মরণ করেন।

তবে রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাস ও উগ্র জঙ্গিবাদ যাতে বিস্তার লাভ না করে সে লক্ষ্যে অধিকার বঞ্চিত রাখাইন মুসলমানদের মূল সমস্যা সমাধানে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে বলা হয়েছে বলে জানান মাহমুদ আলী।

তিনি জানান, “সফরকালে মিয়ানমারের দূত বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিরাপত্তা সংলাপ সহযোগিতা এবং সীমান্ত লিয়াজোঁ অফিস খুলতে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছেন।”

তবে সীমান্ত লিয়াজোঁ অফিসের মাধ্যমে মূল রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

এ প্রসঙ্গে হুমায়ুন কবীর বলেন, “সমস্যা দুই দেশের সীমান্তের নয়, এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ। ওরা লোকজনের ওপর আক্রমণ করছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। এ সমস্যা বর্ডার লিয়াজোঁ অফিস দিয়ে কীভাবে সমাধান সম্ভব?”

তাঁর মতে, মূল সমস্যার দিকে মনোযোগ দিলেই কেবল ইতিবাচক সমাধানের দিকে যাওয়া সম্ভব।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।