রোহিঙ্গা শিবিরে চিকেন পক্সসহ শীতকালীন রোগের প্রকোপ
2019.01.15
ঢাকা ও কক্সবাজার
সাধারণত বসন্তকালে চিকেন পক্সের প্রাদুর্ভাব দেখা গেলেও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে এবার শীতকালেই দেখা দিয়েছে এ রোগ। পাশাপাশি ডায়রিয়াসহ শীতকালীন রোগব্যাধিতে আক্রান্তের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।
আজ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, গত ডিসেম্বর থেকে ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৮৩২জন রোহিঙ্গা চিকেন পক্সে আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে ৫২ শতাংশ উখিয়া এবং ৪৯ শতাংশ টেকনাফ শিবিরের। এদের ৩৯ শতাংশ ৫ বছরের কম বয়সী।
তবে চিকেন পক্সসহ শীতকালীন রোগব্যাধি যাতে ব্যাপকভাবে ছড়াতে না পারে সে জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল মতিন।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প-৪ এর হেডমাঝি আব্দুর রহিম বেনারকে জানান, ‘চিকেন পক্সকে স্থানীয়ভাবে আরাংহা বলা হয়। ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শিশুসহ কিছু লোকজন এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে শুনেছি। তবে আক্রান্তের হার বেশি নয়।”
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. শাহীন আব্দুর রহমান জানান, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের মধ্যে চিকেন পক্সের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। তবে এটি জটিল কোনো রোগ না হওয়ায় বেশিরভাগ চিকেন পক্সে আক্রান্ত রোগিরা হাসপাতালের বহির্বিভাগ চিকিৎসা নিয়ে চলে যায়।”
যাদের চিকেন পক্সের কারণে নিউমোনিয়া বা অন্য জটিল কোনো রোগ দেখা দিচ্ছে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়, জানান তিনি।
ডা. শাহীন বলেন, “বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন ৪-৫ জন চিকেন পক্সের রোগী আসছে। এক মাসে সব মিলিয়ে প্রায় একশো রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। তবে ক্যাম্প এলাকার বিভিন্ন প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও এ ধরনের রোগী যাচ্ছে।”
চিকিৎসকেরা জানান, চিকেন পক্স একটি ছোঁয়াচে রোগ। এটি ভ্যারিসেলা ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। বসন্তকালে এবং শীতকালে এ রোগের প্রকোপ বাড়ে। মূলতঃ পাশাপাশি বসবাসের কারণে এ রোগ ছড়ায়। সারা শরীরে ছোট ছোট ফোস্কার মতো লালচে গোটা দেখা যায়। এর সঙ্গে জ্বর, মাথা ব্যাথা, শরীর ব্যাথা দেখা দিতে পারে।
এটি জটিল রোগ না হলেও ছোঁয়াচে, এ কারণে চিকেন পক্সে আক্রান্ত রোগিদের আলাদাভাবে রাখার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
হাসপাতাল সুত্রে জানায়, মঙ্গলবার কক্সবাজার সদর হাসপাতালের ইনডোরে ভর্তি রয়েছে ৫৬৬জন রোগী। এর মধ্যে ৫৫জন রোহিঙ্গা। এদের বেশিরভাগই শীতকালীন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত।”
কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল মতিন বেনারকে জানান, “মূলতঃ চিকেন পক্স হয় বসন্তকালে কিন্তু এবার একটু আগেই এ রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। তবে চিকেনপক্স নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।”
“এ রোগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভালো হয়ে যায়। এ রোগে কোনো মানুষ মারা যায় না। তাছাড়া এ রোগের কোনো ভ্যাকসিনও নেই। তবে আক্রান্ত হওয়ার পরে একটু সচেতনভাবে চলাফেরা করতে হয়, যেহেতু এটি ছোঁয়াচে রোগ, অন্যজনের কাছে যেন না ছড়ায়,” বলেন তিনি।
ড. মতিন জানান, চিকেন পক্স প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে স্বাস্থ্য বিভাগের এবং বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরা কাজ করছেন। চিকেন পক্সে আক্রান্ত হলে করণীয় সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের চিকিৎসাধীন ৮ বছরের শিশু আজিজা চিকেন পক্সের পাশাপাশি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। তার বাবা রফিক বেনারকে জানান, তিনদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। কাশি একটু কমলেও শরীরের ফোলা কমছে না।
টেকনাফের নয়াপাড়া মুচনী রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে দুই মাসের শিশু মো. হাসানকে নিয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে আসেন মা রশিদা খাতুন (৩৫)। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় হাসপাতালের তিনতলায় শিশু ওয়ার্ডে হাসানকে ভর্তি করানো হয়।
রশিদা বেনারকে বলেন, “ছেলের ঠান্ডা লেগেছে। ওখানে (টেকনাফে) দুই-তিন দিন ওষুধ খাওয়ায়েছি। কিন্তু কাশি আর শ্বাসকষ্ট কমেনি। তাই আজ চারদিন হলো এখানে চিকিৎসা নিচ্ছি। এখন একটু ভালো আছে।”
শুধু এরা নন, ঠান্ডাজনিত রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী কক্সবাজার সদর হাসপাতালসহ উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
তবে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আব্দুল মান্নান বেনারকে বলেন, “উখিয়া হাসপাতালে এখন পর্যন্ত চিকিন পক্সের রোগী আমরা পাইনি। তবে শীতকালীন রোগব্যাধির প্রকোপ স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেড়েছে। তবে মোটেও উদ্বেগজনক নয়।”
তিনি বলেন, “উপজেলা হাসপাতালে ইনডোরে গড়ে ৬০-৭০ জন রোগী ভর্তি থাকে। এদের মধ্যে ২৫ ভাগ রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গাদের মধ্যে সর্দি কাশি, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়ার পাশাপাশি ডায়রিয়া রোগের প্রকোপ একটু বেশি দেখা যাচ্ছে।”
ডা. আব্দুল মান্নান বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী ২২ ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৩২৯জন চিকেন পক্সে আক্রান্ত হয়েছে বলে রিপোর্ট পেয়েছি। তবে এর বাইরে আরো অনেক সংস্থা আছে যারা এখনো রিপোর্ট জমা দেয়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে চিকেন পক্সের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে স্বাস্থ্য খাতের অংশীদাররা নজরদারি বাড়িয়েছে এবং এই রোগের বিস্তার কমানো এবং জটিলতা প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিচ্ছে।
“চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রাথমিকভাবে চিকেন পক্স শনাক্ত করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা প্রচার করার প্রচেষ্টা চলছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে,” বিজ্ঞপ্তিতে বলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. বর্দন জুং রানা।