রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী আরসা প্রধানের ভাইর কাছে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র

শরীফ খিয়াম ও আবদুর রহমান
2022.01.18
ঢাকা ও কক্সবাজার
রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী আরসা প্রধানের ভাইর কাছে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র কক্সবাজারে গ্রেপ্তারের পর এপিবিএন সদস্যদের সাথে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির ভাই মোহাম্মদ শাহ আলী। ১৬ জানুয়ারি ২০২২।
[সৌজন্যে: ১৪ এপিবিএন]

রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির ভাই মোহাম্মদ শাহ আলীর (৫০) কাছে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পেয়েছে পুলিশ। উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক (তদন্ত) গাজী সালাহ উদ্দিন মঙ্গলবার বেনারকে এ তথ্য জানান।

উখিয়ার ছয় নম্বর শিবির থেকে রোববার ভোরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অভিযানে অস্ত্র, মাদক ও অপহৃত এক যুবকসহ গ্রেপ্তার শাহ আলীর ওই এনআইডির অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালি থানার দেওয়ান বাজারের জয়নব কলোনির বাসিন্দা পরিচয়ে ২০১৬ সালে এই পরিচয়পত্র সংগ্রহ করা হয়।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসাইন স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, পরিচয়পত্রটি আসল হলে তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এর আগে শাহ আলী ২০১৯ সালে ঢাকার হাজারীবাগ থানায় দায়ের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছিলেন বলে বেনারকে জানান সালাহ উদ্দিন।

তবে তখন তাঁর আসল পরিচয় জানতে পারেনি কেউ। এমনকি ওই মামলার অভিযোগ এবং ঢাকায় তাঁর গ্রেপ্তার ও জামিনে মুক্তির তারিখ সম্পর্কে মঙ্গলবারও বেনারকে কিছু জানাতে পারেনি উখিয়ার পুলিশ।

“সে যদি সত্যিই জুনুনির ভাই হয়ে থাকে, তবে তার এই পরিচয়টি তখনই উন্মোচিত হওয়া উচিত ছিল। সেটি না হওয়া নিরাপত্তা বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ঘাটতি বলব না, এটা অসম্পূর্ণতা। কারণ এমন মানুষদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ খুব সহজ না,” বেনারকে বলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ।

আরসা কিনা তদন্তে জানা যাবে

আলীকে গ্রেপ্তার ও তাঁর পরিচয় উদঘাটনকে বড়ো সাফল্য বলে মনে করছেন কক্সবাজার ১৪ এপিবিএন অধিনায়ক নাইমুল হক। বেনারকে তিনি জানান, ‘ড্রোন ক্যামেরা’ ব্যবহার করে আগেভাগেই তাঁর অবস্থান চিহ্নিত করা হয়।

“ড্রোন ক্যামেরা ব্যবহার করে এপিবিএনের বড়ো সাফল্য এটা,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সে আরসার জন্য সদস্য কিনা বা এর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা কতটা তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।”

এদিকে এপিবিএনের দায়ের করা মামলার এজাহারে শাহ আলীকে কথিত আরসা সদস্য, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, অপহরণচক্রের হোতা ও মাদক চোরাকারবারি বলে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানান উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত)।

তিনি জানান, রোববাররই আলীর বিরুদ্ধে এই থানায় অপহরণের অভিযোগে মামলা করেন মোহাম্মদ সালেহ (২৮) নামের এক যুবক। এছাড়া অস্ত্র ও মাদক আইনে ১৪ এপিবিএনের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ রুহুল আজম আরো দুটি মামলা দায়ের করেন।

কক্সবাজারের আদালতে সোমবার তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছে জানিয়ে পরিদর্শক সালাহ উদ্দিন আরো বলেন, “তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন মামলায় সাত দিন করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।”

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, আরসা প্রধান জুনুনির নির্দেশেই কক্সবাজারের উদ্বাস্তু শিবিরে অবস্থান করছিল শাহ আলী।

রোহিঙ্গা ইয়ুথ এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা খিন মং মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আরসা প্রধানের ভাইকে ধরার খবর শুনেছি। তবে আসলেই জুনুনির ভাই কিনা সেটি আমাদের জানা নেই।”

“আলী নিজেই স্বীকার করেছে সে জুনুনির ভাই। জুনুনি সম্পর্কে আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে, সেগুলো সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা দেখেছি, সবই মিলেছে। রোহিঙ্গা শিবিরের মাঝিরাও তার পরিচয়ের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন, যারা তাকে আগে থেকেই চিনত,” বেনারকে বলেন এসপি নাইমুল।

তবে “আলীর শিকড় খুঁজে বের করতে” প্রয়োজনে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সহায়তা নেওয়া উচিত বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন অভিবাসন ও শরণার্থী পরিস্থিতি বিশ্লেষক আসিফ মুনীর।

আরসা প্রধানের ভাইকে আটকের বিষয়টি ‘স্বস্তির খবর’ হিসেবে উল্লেখ করে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাস্তবায়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও উখিয়া পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “তবে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, রোহিঙ্গারা বিভিন্ন কৌশলে জাতীয় পরিচয়পত্র বানাচ্ছে। এর সুবাদে তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে।”

“রোহিঙ্গা অপরাধীদের কাছে যদি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ‘ভ্যালিড ডকুমেন্টস’ থাকে, তবে আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের আটকানো অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়,” বলেন আসিফ মুনীর।

একের পর এক হত্যাকাণ্ডসহ শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন অপরাধের জন্য দীর্ঘদিন থেকেই আরসাকে দায়ী করে আসছেন ভুক্তভোগীরা। তবে সরকার বরাবরই বলছে, বাংলাদেশের আরসার অস্তিত্ব নেই।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের ২৪টি পুলিশ চেকপোস্টে নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্যকে হত্যার দায় শিকার করেছিল আরসা। এরই প্রেক্ষিতে তাদের দমনের নামে রোহিঙ্গাদের ‘জাতিগত নিধন’ শুরু হলে রাখাইন থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

আরসা যোদ্ধাদের মহড়ার ভিডিও

রাখাইন রাজ্যের মংডুর একটি শহরে সম্প্রতি আরসা যোদ্ধাদের মহড়ার একটি ভিডিও প্রকাশিত হওয়ায় নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বলে বৃহস্পতিবার এক খবরে জানিয়েছে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতী।

ভিডিওতে আরসা যোদ্ধাদের সঙ্গে আতাউল্লাহসহ আরো দুই শীর্ষ নেতাকে দেখা গেছে জানিয়ে ইরাবতী দাবি করেছে, বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মংডুর কোথাও এই মহড়া হয়েছিল বলে তারা জেনেছে।

গত ডিসেম্বর ও নভেম্বরে আরসার হাতে আক্রান্ত হওয়া মংডুর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমটি বলেছে, বর্তমানে স্থানীয়রা খাবার খুঁজতে গ্রাম ছাড়তে সাহস পাচ্ছে না।

সেখানকার রাখাইন জনগণের মতো মুসলিম বাসিন্দারাও আরসার পুনরুত্থান নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে।

“আরসা উধাও হওয়ার পর আমাদের অঞ্চলটি শান্তিপূর্ণ ছিল। আরসার পুনরুত্থানে স্থানীয় রাখাইনরা হামলার শঙ্কায় আছে,” ইরাবতীতে বলেন মংডুর বাসিন্দা ইউ কো লাট।

সেখান রাখাইন ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো সংঘাত নেই বলেও দাবি করেন তিনি।

মংডুর একটি মুসলিম গ্রামের প্রধান বলেছেন, “আমরা উদ্বিগ্ন যে অতীতে যা ঘটেছে তা আবার ঘটবে। আরসার কর্মকাণ্ডের ফল আমরা ভোগ করব।”

তবে মংডুর বাসিন্দা ও রাখাইন রাজ্যের প্রাক্তন সংসদ সদস্য ইউ তুন হ্লা সেইন এর মতে, “আমি মনে করি না গ্রুপটি আগের মতো বড়ো আকারের চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে পারে। আমি শুনেছি যে শাসকগোষ্ঠী মংডুতে বিপুলসংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করেছে।”

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার ৩৪ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন বিজিবি'র অধিনায়ক মো. মেহেদি হোসাইন কবির বেনারকে বলেন, “সীমান্তের খুব কাছে গোলাগুলির খবর আমরাও শুনেছি। এটা নিয়ে আমরা মিয়ানমারকে অফিসিয়ালি জানিয়েছি। আমরা বলেছি সীমান্তের খুব কাছে গোলাগুলির ঘটনায় আমরা বিব্রত হচ্ছি। কিন্তু তারা (মিয়ানমার) এখনও আমাদের জবাব দেয়নি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।