তিনভাগের একভাগ রোহিঙ্গা নারী ধর্ষণের শিকার

কক্সবাজার থেকে জেসমিন পাপড়ি
2017.01.19
মিয়ানমারে সরকারি বাহিনী দ্বারা ধর্ষিতা রোহিঙ্গা নারী। মিয়ানমারে সরকারি বাহিনী দ্বারা ধর্ষিতা এক রোহিঙ্গা নারী। কুতুপালাং, কক্সবাজার। ১৪ জানুয়ারি ২০১৭। এই নারীকে অজ্ঞাত পরিচয় রাখার জন্য ছবিটি ঝাঁপসা করা হয়েছে।
জেসমিন পাপড়ি/বেনার নিউজ

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে শরণার্থী তিনভাগের এক ভাগ রোহিঙ্গা নারী মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। চলতি সপ্তায় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বেনার নিউজের সাথে সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গা নারীরা এই তথ্য দেন।

বেনার নিউজের বিশেষ সংবাদদাতা রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে চার দিনে ৫৪ জন  নারীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকারে এদের ১৭ জন জানান, রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর অভিযানের সময় তারা  ধর্ষণের শিকার হন।

গত অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী একটি দলের আক্রমণে মিয়ানমারের ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হন। এর প্রতিক্রয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে সহিংস অভিযান শুরু করে। অভিযানের সময় ধর্ষণ ও হত্যার মতো বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে এখন পর্যন্ত ৬৫ হাজারের মতো রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন।

বিভিন্ন সময় মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ উত্থাপিত হলেও এ বিষয়ে সাক্ষাৎকারভিত্তিক কোনো জরিপের ঘটনা এই প্রথম। সম্প্রতি অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গা নারীদের মধ্য থেকে দৈব চয়নের ভিত্তিতে সাক্ষাৎকার নিয়ে যৌন নির্যাতনের এই চিত্র পাওয়া যায়।

বেনারের সাথে কথা বলার সময় শরণার্থীরা ঘরবাড়ি ও গবাদিপশু পুড়িয়ে দেয়া, মারধর এবং পরিবার সদস্যদের হত্যার মতো অন্যান্য নির্যাতন এবং সহিংসতার বর্ণনাও দেন।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী বা আধা-সামরিক নাডালা বাহিনী দ্বারা রাতের বেলাতেই এইসব নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা ঘটত বলে তারা বেনারকে জানান।

কুতুপালাং ক্যাম্পের শরণার্থী, রাখাইন রাজ্যের মংডু উপজেলার নাইসাপ্রো গ্রামের সেতারা বেগম (২৪) জানান, রাতে খাবার খাওয়ার সময় সেনারা তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর আরও কয়েকজন নারীর সাথে তাকে পাহাড়ে নিয়ে “পালাক্রমে” নির্যাতন চালায়।

“বর্বর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে দুজন সেখানেই মারা যায়। ধর্ষিত হওয়ার পর আমি কোনো মতে পালিয়ে আসি।” জানান সেতারা বেগম।

সেতারার বর্ণনায়, “তারা কাপড় খুলে বুকে ও গায়ে কামড় দিয়েছে। ওদের যা মন চায় তাই করেছে।”

সেতারার ভাষ্য অনুযায়ী, ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরে তার স্বামী তাকে উদ্ধার করেন। ততক্ষণে সেনারা তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। ফলে পরের কয়েক দিন তাদেরকে পাহাড়ে পাহাড়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়।

১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রবেশ করেন জানিয়ে সেতারা বলেন, “দশদিন পর্যন্ত ভাত জোটেনি। আমার ছোট ছোট তিনটা ছেলেমেয়ে ঘাস-পাতা খেয়ে বেঁচে ছিল। বাংলাদেশে এসে অন্তত তারা কিছু খেতে পাচ্ছে।”

কঠোর সমালোচনার মুখে মিয়ানমার

জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের উপর মানবিক বিপর্যয় বিষয়ে বৃহস্পতিবার কুয়ালালামপুরে ৫৭টি মুসলিম দেশের নেতৃবৃন্দ এক বিশেষ সভায় মিলিত হন।

সভায় রোহিঙ্গাদের উপর চলা বিপর্যয়কে ইসলামি চরমপন্থীরা অপব্যবহার করতে পারে বলে মিয়ানমারকে সতর্ক করে দেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাক। বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং সব ধরনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার ফলে সেখানে চরমপন্থার উত্থান হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

রাখাইন রাজ্যে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এবং মানবাধিকার কর্মীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে মিয়ানমারের নেত্রী আং সান সুচির বিশেষ তদন্ত কমিশন রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনীর কোনো নির্যাতন বা গণহত্যার অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে।

অবশ্য মাসের শুরুতে রোহিঙ্গাদের উপর নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনের একটি ভিডিওচিত্র প্রকাশিত হবার পর মিয়ানমার সরকার নির্যাতনকারী কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করে।

নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা রোহিঙ্গা নির্যাতন বিষয়ে আলোচনার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংগহি লি গত বুধবার মিয়ানমারের নেত্রী আং সান সুচির সাথে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক ডেপুটি ডিরেক্টর ফিল রবারস্টন-এর মতে, “আং সান সুচি এবং তার সরকারের সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব রয়েছে।”

উল্লেখ্য যে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ রাখাইনে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে।

হিউমন্যান রাইটস ওয়াচের নিজস্ব তদন্তেও মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেরিয়ে এসছে।

“তারপরেও ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের পরিবর্তে মিয়ানমার সরকার ক্রমাগতভাবে সবকিছু অস্বীকার করার নিষ্ঠুর খেলায় মেতে আছে।” বেনারকে বলেন রবারস্টন।

কয়েকটি ঘটনা

মংডুর নাইসাপ্রো নোরাবিল গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা ৩১ বছরের আরেক শরণার্থী নূর জাহান। তার স্বামীকে সেনারা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাবার তিন সপ্তাহ পরে তিনি ধর্ষিত হন বলে বেনারকে জানান। তার স্বামী এখনো নিখোঁজ।

তিনি বলেন, “১৪ ডিসেম্বর ঘরে ঢুকে দুজন মিলিটারি আমাকে চেপে ধরে আর আরেকজন ধর্ষণ করে। একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারাই। তারপরে অন্য কেউ ধর্ষণ করেছে কিনা, আমি জানি না।”

স্থানীয় উপজাতি প্রধান গ্রাম পরিদর্শনে এলে তিনি তাকে ঘটনার বিষয়ে অভিযোগ করেন। কিন্তু এর ফলে উপজাতি প্রধান চলে যাবার পর পরই সেনারা তার বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে বলে তিনি জানান। পরে তিনি পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন। এখানে এসে কিছু চিকিৎসা সহায়তাও পেয়েছেন।

তিনি বলেন, “অত্যাচারে আমার শরীর ফুলে যায়। ওই অবস্থায় এ দেশে পালিয়ে আসি। এখানে এসে আমি কিছু চিকিৎসা পাই।”

লেদা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া ১৯ বছরের সেনোয়ারা বেগম বাংলাদেশে আসার পর জন্ম হওয়া নবজাতককে কোলে নিয়ে বেনারের সাথে কথা বলেন। তিনি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ধর্ষিত হয়েছেন বলে জানান।

আট দিন আগে সন্তান প্রসব করা মংডুর জাইমুন্ন্যা গ্রামের এই নারী বলেন, “আমার পেটে আট মাসের বাচ্চা থাকা অবস্থায় ওরা আমাকে বন্দুক দেখিয়ে ধর্ষণ করে।”

সেনোয়ারার মুখের বাম পাশে মানুষের কামড়ের দাগ স্পষ্ট। সেনারা ধরে নেওয়ার পর তার স্বামী কোথায় আছে, তা জানেন না এই নারী।

ধর্ষিতার সংখ্যা অনেক

স্থানীয় রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ এবং এনজিও কর্মকর্তাদের মতে নতুন আসা বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গা নারীর মধ্যে ঠিক কতজন ধর্ষিতা তা সঠিকভাবে বলা না গেলেও এটা নিশ্চিত যে এই সংখ্যা অনেক।

টেকনাফের কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা (মাঝি) তৈয়ব আলী বেনারকে বলেন, “বলতে গেলে প্রতি দিনই নির্যাতিতরা আসছে। ধর্ষণের কথা অনেকে লজ্জায় স্বীকার করে না। তবে আমি বলতে পারি যে এ সংখ্যা অনেক।”

“অনিবন্ধিত এই ক্যাম্পের প্রায় প্রতিটি ঘরে নতুন রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে ধর্ষিতার সংখ্যা অনেক। পুরাতনদের পাশাপাশি নতুনদেরকেও আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছি।” বেনারকে জানান লেদা শরণার্থী ক্যাম্পে কর্মসূচি পরিচালনা করা বাংলাদেশ জার্মান সম্প্রীতি’র কর্মী সামিরা আক্তার।

মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সহিংসতায় নতুন অনুপ্রবেশের আগে জাতিসংঘের দুটি শরণার্থী শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার। আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অনিবন্ধিত অবস্থায় বসবাস করা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ছিল আরো প্রায় তিন লাখ। এসব জায়গায় মূলত নিজেদের উদ্যোগে বাঁশ এবং পলিথিন দিয়ে বানানো ছাপড়াতেই তারা বসবাস করেন। এসব ক্যাম্পে গড়ে প্রতি পাঁচ হাজার মানুষের জন্য একটি পানির উৎস এবং একটি টয়লেটের ব্যবস্থা রয়েছে বলে ক্যাম্পগুলো ঘুরে জানিয়েছেন বেনার নিউজের বিশেষ সংবাদদাতা।

নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতেও নতুন অনেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বলে বেনারকে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউএনএইচসিআরের একজন কর্মী। শুধু টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পেই এ সংখ্যা ত্রিশ হাজারের বেশি হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “এদের মধ্যে অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার। আর এই নির্যাতনের মাত্রা অত্যন্ত নির্মম। গর্ভবতী অবস্থায় ধর্ষিত হয়ে গর্ভপাতের ঘটনাও রয়েছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।