বাংলাদেশ–মিয়ানমার চুক্তি: প্রতিবাদে রোহিঙ্গাদের আকস্মিক বিক্ষোভ
2018.01.19
ঢাকা ও কক্সবাজার
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তির প্রতিবাদে কক্সবাজারে গতকাল শুক্রবার বিক্ষোভ করেছেন বেশ কিছু রোহিঙ্গা। এদিকে রোহিঙ্গা অধিকার প্রতিষ্ঠা কমিটি নামে একটি সংগঠন প্রত্যাবাসনের আগেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে। অন্যথায় তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে অনাগ্রহ দেখিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেওয়া বিভিন্ন পয়েন্টে ২১ দফা দাবি সংবলিত পিভিসি সাইনবোর্ডে লাগিয়েছে রোহিঙ্গা অধিকার প্রতিষ্ঠা কমিটি। উখিয়া ও টেকনাফে প্রায় দুই শতাধিক সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে সংগঠনটি।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন জানুয়ারি মাসেই শুরু করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার যখন পুরোদমে কাজ করছে তখন এই বিক্ষোভ ও সাইনবোর্ড ঝোলানোর ঘটনা ঘটল।
কুতুপালংয়ে আকস্মিক বিক্ষোভ
কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে গতকাল বিক্ষোভের সময় রোহিঙ্গারা তাঁদের ফেরত পাঠানোর আগে মিয়ানমারে নাগরিকত্ব এবং সেখানে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দাবি করেন। এ ছাড়া মিয়ানমারে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি নিরাপদ এলাকা গড়ে তোলার দাবি জানান তাঁরা।
বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা অবশ্য জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের এ ধরনের বিক্ষোভের কোনো তথ্য তাঁদের জানা নেই। তবে এএফপি, বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে।
এদিকে কুতুপালংয়ে স্থানীয় সাংবাদিক এবং রোহিঙ্গাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা এই বিক্ষোভ সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
উখিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিকারুজ্জামান স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, এ ধরনের কোনো বিক্ষোভের কথা তিনি শোনেননি।
তবে কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে বেশ কিছু রোহিঙ্গা বিক্ষোভ করেছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। তিনি বর্তমানে উখিয়া অবস্থান করছেন।
খান বলেন, “শুক্রবার কুতুপালং ক্যাম্পের ব্লক-বি এবং ব্লক-ই তে সকাল আটটায় এবং দুপুর আড়াইটায় দুটো বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়, যদিও প্রতিবাদ কর্মসূচি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।”
তিনি বলেন, “প্রতিবাদ প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে নয়। তাঁদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাঁদের কথা, আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু রাখাইনে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো আসেনি।”
লিটন বলেন, তাঁদের দাবি, প্রত্যাবাসনের আগে তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে, তাদের সেফটি ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে হবে, তাঁদের জাতিসংঘের অধীনে ফিরে পাঠাতে হবে। প্রথমে তাঁদের একটি সেফ জোনে নিয়ে রাখতে হবে এবং পরে তাঁদের নিজ নিজ বাড়ি-ঘরে যেতে দিতে হবে।
তিনি বলেন, আরেকটি দাবি হলো তাঁদের সম্পদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ও যারা হত্যা, ধর্ষণ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে তাঁদের বিচার করতে হবে।
তারা বলছেন, এগুলো নিশ্চিত করার আগে ফেরত পাঠানোর চেয়ে সাগরে ফেলে দিন বা গুলি করে মেরে ফেলেন। তবু রাখাইনে ফেরত পাঠাবেন না।
২১ দফা দাবি সংবলিত সাইনবোর্ড
রোহিঙ্গা অধিকার প্রতিষ্ঠা কমিটির নেতারা সাইনবোর্ডে লিখেছেন, নাগরিকত্ব নিশ্চিত না করে তাঁদের প্রত্যাবাসিত করলে তারা আবার নির্যাতনের শিকার হবেন। তাঁরা তাঁদের দাবি বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে হস্তান্তর করবেন।
বাংলাদেশ এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না জানালেও রোহিঙ্গাদের এই দাবিগুলো সরকারের অবস্থানের সঙ্গে মিল রয়েছে। ২৩ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার কথা জানায় মিয়ানমার সরকার।
তবে বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ শব্দগুলো বাংলাদেশের সম্মতি ছাড়াই বাদ দেয় মিয়ানমার। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশ কার্যবিবরণীতে স্বাক্ষর করেনি।
সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক গঠিত রাখাইন উপদেষ্টা কমিটি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানসহ তাঁদের সকল নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে সুপারিশ করেছে।
মিয়ানমারের সংবাদপত্র ইরাবতী ১৩ সেপ্টেম্বর জানায়, মিয়ানমার সরকার কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন জন্য উ মিন্ট সোয়ের নেতৃত্বে ১৫-সদস্যের একটি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করেছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক আলী হোসেন বেনারকে বলেন, “কারা দাবি সংবলিত বোর্ডগুলো বসিয়েছে আমার জানা নেই। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “আমরা তো বারবার বলেছি রোহিঙ্গাদের অধিকার দিতে হবে যাতে তাঁরা তাঁদের দেশে থাকে। আমি অং সান সুচিকে বলেছি, আপনারা কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করুন। তিনি আমাকে বলেছেন তার সরকার কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে অনেক দুর এগিয়েছেন।”
মন্ত্রী বলেন, “আমি তাঁকে বলেছি, আপনারা তাঁদের দ্রুত ফিরিয়ে না নিলে তাঁদের অনেকেই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের দিকে যেতে পারে।”
কুতুপালং ক্যাম্পের মধুরছড়ার মাঝি আবদুল খালেক রোহিঙ্গা অধিকার প্রতিষ্ঠা কমিটির সমর্থক। তিনি বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ সরকারসহ জাতিসংঘ ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে আমাদের একটিই অনুরোধ, নাগরিকত্ব নিশ্চিত করেই যেন আমাদের ফেরত পাঠানো হয়। আমরা যেন হারানো সম্পত্তি ফিরে পাই, ক্ষতিপূরণ পাই। অন্যথায় আবারও আমরা অথই সাগরে ভাসব।”
তিনি বলেন, “আমাদের দাবিগুলো বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে হস্তান্তর করা হবে।”
আমতলী ক্যাম্পের মাঝি আব্দুল হাকিম বেনারকে বলেন, “আমরা এই দাবিগুলোর সঙ্গে একমত। প্রত্যাবাসনের আগে রোহিঙ্গা জনগণকে তাঁদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”
কুতুপালং এ ব্লকের নারী মাঝি ছৈয়দা বেগম বলেন, মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ সহ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে এমন শর্তেই যেন মিয়ানমার ফেরত পাঠানো হয়। না হলে আমি ফিরে যেতে চাই না।
অন্যান্য দাবি
উখিয়া উপজেলার কুতুপালং, বালুখালী, জামতলী, থাইনখালী ও টেকনাফ উপজেলার লেদা পয়েন্টে রোহিঙ্গা ক্যাম্প অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় স্থাপিত শতাধিক এ রকম পিভিসি সাইনবোর্ডে বাংলা ও ইংরেজিতে ২১ দফা দাবি উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্ব সম্প্রদায় ও মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এতে উল্লেখিত বিষয়গুলো হলো:
রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার আগে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা, রোহিঙ্গাদের যে সব বসতবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ মিয়ানমার কর্তৃক সরকারিভাবে দেওয়া, রোহিঙ্গাদের বাড়ি ঘরের জমি জমা কোনো শর্ত ছাড়া কাগজে কলমে ফেরত দেওয়া এবং রোহিঙ্গাদের আবাসভূমির পুরোনো নাম আরাকান এস্টেট করা।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্বাধীনভাবে ব্যবসা–বাণিজ্যের অধিকার এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের মালামালের নিরাপত্তা প্রদানের দাবি করা হয়।
তাঁদের আরও দাবি হচ্ছে; আরাকান প্রদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা বিচার ব্যবস্থা ও রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে বিচারক নিয়োগ প্রদান, মিয়ানমারে কারাবন্দী রোহিঙ্গাদের নিঃশর্ত মুক্তি এবং আরকান প্রদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা কারাগার স্থাপন।
রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা মুসলিম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়েছে। রোহিঙ্গা আলেম-ওলামাদের পাঞ্জাবি–পায়জামা ও টুপি পরতে বাধা না দেওয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করারও দাবি জানানো হয়েছে।
মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমা বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দাবি করা যৌক্তিক। তাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত না করে প্রত্যাবাসন করা হলে তারা আবার বাংলাদেশে ফিরে আসবে।”
তিনি বলেন, তবে আশার কথা হলো মিয়ানমার সরকার কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে আগ্রহী। ২২ জানুয়ারি কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কমিটির সভা রয়েছে। আশা করা যায় হয়ত ওই সভায় রোহিঙ্গাদের অধিকারের ব্যাপারে কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে।
তবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া মিয়ানমার সরকারের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেন অনুপ চাকমা।