শিশুদের বর্ণনায় রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ
2017.01.23

নিজের ভাইবোনকে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী চোখের সামনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে দেখেছে, এবার এমনই বর্ণনা দিলো শরণার্থী রোহিঙ্গা শিশুরা।
বেনার নিউজের বিশেষ সংবাদদাতা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে গত সপ্তাহে ১৯ জন শিশুর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি রাখাইন রাজ্যের সহিংসতার সাক্ষী, এগারো থেকে বারো বছরের রোহিঙ্গা শিশুরা এই বীভৎসতার বিবরণ দেয়।
ঘটনা বলতে গিয়ে ১১ বছরের তাসমিন খাতুন জানায়, “মিলিটারিরা আমার বড়ো ভাইকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে। আমাদের ঘরে আগুন দিয়েছে। মেয়েদের ওপর জুলুম করেছে।”
উখিয়ার কুতুপালাং অনিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী এই শিশুটি জানায় “আমরা জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলাম। সেসব কথা ভাবলে এখনো ভয় পাই। রাতে ঘুমাতে পারি না।”
গত অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী একটি দলের আক্রমণে মিয়ানমারের ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হন। এর প্রতিক্রয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যের মংডুর আশপাশে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে সহিংস অভিযান শুরু করে। অভিযানের সময় ধর্ষণ, হত্যা ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেবার মতো বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে প্রায় ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হন।
তবে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা নির্যাতনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কঠোর সমালোচনার পরও মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের উপর নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো নির্যাতন বা গণহত্যার অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে।
গত সপ্তায় শরণার্থী ৫৪জন রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষাৎকার ভিত্তি করে বেনার নিউজ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে এদের ১৭ জন জানিয়েছেন যে তারা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার।
আগুনে পুড়িয়ে শিশু হত্যা
টেকনাফের লেদা শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গা শিশু আব্দুল মালেক জানায়, সেনারা তাদের ঘরে আগুন দিয়ে, সেই আগুনের মধ্যে তার জমজ ভাইকে ফেলে পুড়িয়ে মেরেছে।
“মিলিটারি আমার জমজ ভাইকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলেছে। …তারা সবাইকে আগুনে পুড়িয়ে মারছে।” বেনারকে বলে রোহিঙ্গা বালক আব্দুল মালেক।
মিলিটারি গুলি করলেও সে এবং তার পরিবারের বাকিরা নদীতে ঝাঁপিয়ে কোনো মতে পালাতে পেরেছে বলে বেনারকে জানায় মালেক।
প্রায় একই ধরনের বিবরণ দেয় উখিয়ার কুতুপালাং শিবিরের ১২ বছরের শিশু জহুর আলী। সে জানায়, মিলিটারি তাদের ঘরে আগুন দেবার পর তার ছোট দুই জমজ ভাইকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে আগুনে ফেলে পুড়িয়ে মারে।
শিশুটির মা রহিমা খাতুন (৩৫) বেনারকে বলেন, “সেসব কথা মনে হলে ঘুমের মধ্যেও কেঁদে ওঠে জহুর। জানি না কবে ওর মন থেকে সেসব ভয়ংকর দৃশ্য মুছে যাবে।”
টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত ক্যাম্পের ১২ বছরের আরেক শিশু মো. নাজিউদ্দিন জানায়, মাত্র কয়েক মাস আগে মা মারা যাওয়ায় ছয় ভাইবোনের একমাত্র অবলম্বন ছিলেন বাবা ওছান আহমেদ। কিন্তু কিছুদিন আগে রাখাইনের জাম্মুইন্না গ্রামের বাড়ি থেকে বাবাকে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমারের সেনারা। এক বছরের ছোট ভাইকে নানা বাড়ি রেখে বাকি পাঁচ ভাইবোন প্রতিবেশী এক চাচির সঙ্গে বাংলাদেশে আসে।
নাজিমউদ্দিন চোখের সামনে বাবাকে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হতে দেখেছে। তার দুই ভাইবোন, দুই বছরের মো. ইয়াছিন ও চার বছরের উম্মে সালমাও সব দেখেছে। গত এক মাসেও স্বাভাবিক হতে পারেনি ওই দুই শিশু। নাজিমউদ্দিন তাই প্রায় সারা দিনই তাদের কোলে নিয়ে বসে থাকে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর একজন কর্মকর্তার মতে গত অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে।
এর বাইরে আরো তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা বহু বছর থেকেই বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউএনএইচসিআরের এক কর্মকর্তা জানান, “নতুন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য আমরা একটি জরিপ চালাচ্ছি। এখন পর্যন্ত ৫ হাজার শিশুসহ ১২ হাজার নতুন রোহিঙ্গা নথিবদ্ধ করা হয়েছে।”
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন জানান, নতুন করে কতজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, এমন জরিপ এখনো হয়নি বলে শিশুদের সংখ্যাও জানা যায়নি।
“ইপিআই কর্মসূচির আওতায় নতুন পুরোনো সব রোহিঙ্গা শিশুকে টিকা দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত না হয়।” জানান কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক।
তবে লেদা ক্যাম্পের বি ব্লকের নেতা (মাঝি) মো. আলম আক্ষেপ করে বেনারকে বলেন, “এসব শিশুদের পেটে এখন খাবার দেওয়াটাই সবচে বড়ো চ্যালেঞ্জ।”
এ প্রসঙ্গে শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন রামরুর নির্বাহী পরিচালক সি আর আবরার বেনারকে বলেন, “একটা ভয়ানক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে আসা এসব শিশুরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এ থেকে উত্তরণের জন্য তাদের কাউন্সেলিং দরকার। তবে সেই সুযোগ কোথায়? ওদের অনেকে তো এখনো পেটভরে খেতেই পারছে না।”