হামলার শিকার খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের শিবির থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে

আবদুর রহমান ও শরীফ খিয়াম
2020.01.28
কক্সবাজার ও ঢাকা
200128_Christian_Rohingya_620.jpg উখিয়ায় বেষ্টনী ঘেরা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ট্রানজিট ক্যাম্প। এখানেই হামলার শিকার হওয়া ১৭টি খ্রিস্টান রোহিঙ্গা পরিবারকে এনে রাখা হয়েছে। ২৮ জানুয়ারি ২০২০।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

কক্সবাজার উখিয়ার কুতুপালং-এ হামলার শিকার হওয়া খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের শিবির থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সাময়িকভাবে তাঁদের জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ট্রানজিট সেন্টারে রাখা হয়েছে।

মঙ্গলবার বিকেলে উখিয়ার ট্রানজিট সেন্টারের বাইরে বেনারের সঙ্গে কথা হয় সাইফুল ইসলাম ওরফে পিটার নামে এক ভুক্তভোগী খ্রিস্টান রোহিঙ্গার।

তিনি বেনারকে জানান, কুতুপালং এ বসবাসরত ২৫টি খ্রিস্টান পরিবারের মধ্যে ১৭ পরিবারকে ট্রানজিট সেন্টারে এনে রাখা হয়েছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মাহবুব আলম তালুকদার বেনারকে বলেন, “পরিস্থিতি ঠিক হয়ে গেলে তাঁদেরকে আবার ক্যাম্পে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। আপাতত তাঁরা ট্রানজিট ক্যাম্পেই থাকবেন।”

“পরবর্তীতে যদি সুবিধা মনে করি তবে পুরোনো ক্যাম্পেই তাঁদের নিয়ে যাব, আর যদি তা না হয় তবে অন্য কোনো ক্যাম্পেও নেওয়া হতে পারে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সাথে আলোচনা করে আমরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।”

সোমবারের (রোববার দিবাগত রাত) ওই হামলার জন্য খ্রিস্টান রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জঙ্গি গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে (আরসা) দায়ী করলেও পুলিশের মতে, হামলার কারণ সাধারণ বিরোধ।

হামলা প্রসঙ্গে সাইফুল বেনারকে জানান, “রোববার দিবাগত রাতে আরসার একটি সশস্ত্র দল আমাদের ঘরে ধারালো অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ চালায়।”

ওই আক্রমণে ২৫টি খ্রিস্টান পরিবারের প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা আশ্রয় হারিয়েছেন জানিয়ে সাইফুল বলেন, “আমরা (খ্রিস্টান রোহিঙ্গারা) ট্রানজিট সেন্টারেও খুব আতঙ্কের মধ্যে আছি।”

তবে পুলিশের উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল মনসুরের দাবি, “আরসা বা কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই ঘটনা ঘটিয়েছে তা সঠিক নয়। বিষয়টি শিবিরের একটি সাধারণ ঘটনা।”

“রোববার তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে সাইফুল নামের এক খ্রিস্টান রোহিঙ্গা শুক্কুর নামের এক মুসলিম রোহিঙ্গার উপর হামলা করলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। পরে শুক্কুরের স্বজনরা ক্ষুব্ধ হয়ে সাইফুল ও তাঁর স্বজনদের ওপর হামলা চালালে ওই পক্ষের চারজন আহত হন,” বলেন তিনি।

তবে সাইফুলের দাবি, আরসা-ই এই হামলা চালিয়েছে, তারা ঘরবাড়ি লুটপাট করছে, পুড়িয়েও দিয়েছে।

এছাড়া ওই হামলায় ১৭ পরিবারের ৭০ জন খ্রিস্টান রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন বলেও দাবি করেন ওসি মনসুর।

এদিকে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ঢাকা অফিসের মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বিষয়টিকে ‘স্পর্শকাতর’ উল্লেখ করে এ নিয়ে কথা বলতে চাননি। বেনার প্রতিনিধিকে উখিয়ার ট্রানজিট সেন্টারে ঢুকতেও বাধা দিয়েছেন সংস্থাটির স্থানীয় কর্মকর্তারা।

পরে সেন্টারের বেষ্টনীর ওপাশে দাঁড়িয়েই বেনারের সাথে আলাপ করেন সেখানে আশ্রয় নেওয়া খ্রিস্টান রোহিঙ্গা সেলিম আদনান। বেনারকে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে।”

পুলিশের হিসেবে সংঘর্ষে আহতের সংখ্যা পাঁচজন হলেও তিনি জানান, কমপক্ষে আট খ্রিস্টান রোহিঙ্গা হাসপাতালে রয়েছেন। আহতদের মধ্যে চারজনের অবস্থা সংকটাপন্ন উল্লেখ করে সেলিম বলেন, “হামলা হতে পারে এমন আভাস পেয়ে আগে থেকেই স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।”

তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন পুলিশের উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল মনসুর। তিনি বেনারকে বলেন, “এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়নি। তবে অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এদিকে বাংলাদেশি সংখ্যালঘুদের সর্ববৃহৎ সংগঠন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম থেকে জানান, বিষয়টি নিয়ে তিনি কক্সবাজারের স্থানীয় সংখ্যালঘু নেতাদের সাথে কথা বলেছেন।

“ঢাকায় ফিরে জাতীয় পর্যায়ের খ্রিস্টান নেতাদের সাথে কথা বলে এ ব্যাপারে করণীয় ঠিক করব,” বেনারকে বলেন তিনি।

‘এক পরিবার নিখোঁজ’

সাইফুলের অভিযোগ, রবিবার দিবাগত রাতের হামলার পর থেকে একটি খ্রিস্টান পরিবার নিখোঁজ রয়েছে। তাঁদের উদ্ধারের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আরসা তাদের নিয়ে গেছে দাবি করে তিনি বলেন, “দ্রুত উদ্ধার করা না হলে তাদেরকে মেরে ফেলবে ওই সন্ত্রাসীরা।”

যদিও কক্সবাজার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বেনারকে বলেন, “কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই ঘটনা ঘটিয়েছে তা সঠিক নয়। একটি সাধারণ বিষয় নিয়ে ঘটনাটি ঘটেছে।”

“পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক রয়েছে। পুলিশ সেখানে নজরদারি বাড়িয়েছে,” যোগ করেন জেলা পুলিশের এই মুখপাত্র।

কুতুপালং (পূর্ব) ক্যাম্পের সহকারী ক্যাম্প ইনচার্জ মোহাম্মদ আতাউর রহমান বেনারকে বলেন, “যাতে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে, সেদিকে নজর রাখা হয়েছে। মূলত দুটি পক্ষের মধ্যে ধর্ম নিয়ে মত পার্থক্য রয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখছেন।”

এদিকে কোনো পরিবার নিখোঁজের বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ জানায়নি বলেও দাবি করেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

প্রসঙ্গত, সরকার বাংলাদেশে আরসার উপস্থিতি বরাবরই অস্বীকার করে থাকে। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগে বিভিন্ন সময় আরসাকে দায়ী করেছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।