রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: মিয়ানমার-বাংলাদেশের বৈঠকে যাচাই-বাছাই দেরির কারণ খুঁজতে দুই পক্ষ সম্মত

জেসমিন পাপড়ি
2022.01.28
ঢাকা
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: মিয়ানমার-বাংলাদেশের বৈঠকে যাচাই-বাছাই দেরির কারণ খুঁজতে দুই পক্ষ সম্মত রাখাইনের রাজধানী সিত্তের বও দু ফা এলাকার অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত শিবিরের একটি বাজারে কেনাকাটা করছেন রোহিঙ্গারা। ৪ জুলাই ২০২১।
[এএফপি]

দীর্ঘ এক বছর পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ে (ভেরিফিকেশন) মিয়ানমারের ধীরগতিতে হতাশা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ।

গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখলের পর রোহিঙ্গা বিষয়ে দুই সরকারের মধ্যে এটাই প্রথম আলোচনা।

বৃহস্পতিবার রাতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দুই দেশের নবগঠিত ‘অ্যাড-হক টাস্কফোর্স ফর ভেরিফিকেশন অব দ্য ডিসপ্লেসড পার্সনস ফ্রম রাখাইন’ এর বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা জানায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, কারিগরি পর্যায়ের এই আলোচনায় কক্সবাজারে আশ্রয় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারা রাখাইনের বাসিন্দা ছিলেন কি না, সেই যাচাই-বাছাইয়ে বিলম্বের কারণ খুঁজে বের করতে উভয়পক্ষ নিজেদের সদিচ্ছার কথা তুলে ধরেছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের এবং মিয়ানমারের ইমিগ্রেশন ও পপুলেশন মন্ত্রণালয়ের উপ-মহাপরিচালক ইয়ে তুন দেশটির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।

বৈঠক হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে অগ্রগতি আশা করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান খুব দ্রুত এসে যাবে এরকম আশা করা যাচ্ছে না।”

“মিয়ানমারের উপরে যদি যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করা যায়, যে চাপ তাদের জন্য কষ্টকর হবে; তাহলেই একমাত্র তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হবে। যতদিন সেটা সম্ভব না হচ্ছে ততদিন তারা এরকম কালক্ষেপণ করতে থাকবে। মিটিং হবে, বিভিন্ন বিষয়ে দুপক্ষ একমত হবে কিন্তু প্রকৃত অগ্রগতি আর হবে না,” বলেন তিনি।

তবে মিটিং হওয়া গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে সাবেক এই পররাষ্ট্রসচিব বলেন, “এসব মিটিংয়ে অগ্রগতি না হোক, এ বিষয়ে আলোচনাকে সচল রাখতে হবে।”

“মিয়ানমার বিভিন্ন সময় বলেছে, আমরা চেষ্টা করছি কিন্তু বাংলাদেশর পক্ষ থেকে সাড়া পাচ্ছি না। এই সুযোগ তাদেরকে দেওয়া যাবে না,” মনে করেন তৌহিদ হোসেন।

গত বছরের ১৯ জানুয়ারি চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে পর এটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রথম বৈঠক।

ত্রিপক্ষীয় ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দুই দেশের ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর মধ্যে ফেব্রুয়ারির শুরুতে মিয়ানমারে অং সান সু চির সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক জান্তা।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ছয় দফায় মোট ৮ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৪২ হাজারের ভেরিফিকেশন শেষ করেছে মিয়ানমার।

বাংলাদেশের হতাশা

বৃহস্পতিবারের বৈঠকে প্রত্যাবাসন কমিশনার রেজওয়ান হায়াত রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইর ক্ষেত্রে মিয়ানমারের তরফ থেকে ধীরগতির বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়।

এ সময় তিনি দ্রুততার সঙ্গে ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত তিনটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আলোকে সব ধরনের সহায়তার প্রস্তাবও দেন।

“বৈঠকে রেজওয়ান হায়াত বলেন, আটকে থাকা ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে জটিলতা ও ঘাটতি দূর করতে পারলে বাস্তুচ্যুত মানুষদের টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে। এক্ষেত্রে রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি এবং বাস্তুচ্যুত মানুষদের মাঝে আস্থা ফেরানোও দরকার,” জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

“কারিগরি জটিলতা ও তথ্যের ঘাটতির কথা তুলে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল বৈঠকে অনিষ্পন্ন ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া শেষ করতে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষ করতে টাস্কফোর্স কার্যকর থাকবে বলে ইয়ে তুন ও আশা প্রকাশ করেছেন,” বিবৃতিতে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন। এর আগে থেকে অবস্থান করা আরও চার লাখসহ বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছেন।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি।

২০১৯ সালে দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে নাগরিক অধিকার ও রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে রোহিঙ্গারা সেখানে ফিরতে রাজি হননি।

আশার আলো দেখছেন রোহিঙ্গারা

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে দুদেশের মধ্যে বৈঠকের খবর রোহিঙ্গাদের জন্য কিছুটা হলেও আশার আলো বলে মনে করেন কক্সবাজারের শিবিরে রোহিঙ্গা ইয়ুথ এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা কিন মং।

তিনি বেনারকে বলেন, “বৈঠকটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সব সময় আশা করি রোহিঙ্গারা একদিন নিজ দেশে ফিরতে সক্ষম হবে। দুদেশের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে থাকলে একদিন না একদিন সমাধানের পথ খুলবে।”

“তবে আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের উপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে, না হলে যেকোনো সময় মিয়ানমার সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারে,” মনে করেন তিনি।

টেকনাফ লেদা ক্যাম্পে ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর আগে সেদেশের পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া খুব জরুরি। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হবে।”

“মিয়ানমারকে বিশ্বাস করা খুব কঠিন। তবে আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে কাজ করছে। এবং সত্যিই একদিন আমরা নিজ ঘরে (মিয়ানমারে) ফিরব,” বলেন তিনি।

ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ লাখ ডলার দেবে জাপান

ভাসানচরে অবস্থানরত মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য বিশ লাখ ডলারের জরুরি সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাপান সরকার।

এর মধ্যে দশ লাখ ডলার জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা-ইউএনএইচসিআরকে আর বাকি দশ লাখ ডলার বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকে (ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম) দেওয়া হবে। প্রাপ্ত অর্থ সংস্থা দুটি ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় করবে। শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একথা জানিয়েছে ঢাকায় জাপান দূতাবাস।

ঢাকায় জাপানের রাষ্ট্রদূত আইটিও নাওকি বলেন, জাপান সরকার ২০২১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের মধ্যে স্বাক্ষরিত এমওইউ-এর অধীনে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চলমান কার্যক্রমে সহায়তা দিচ্ছে যা ভাসানচরের জন্য সহায়তা প্রদানের একটি মৌলিক কাঠামো।

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”

রাষ্ট্রদূত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির কাজের প্রশংসা করেন। 

নাওকি বলেন, “জাপান আশা করে, জাতিসংঘ ভাসানচরে বিদ্যমান ও ক্রমবর্ধমান মানবিক সহায়তা ও সুরক্ষার প্রয়োজনে সাড়া দেবে। এই সহায়তা আরো ভালো পরিষেবা প্রদানে এবং ভাসানচরে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতিতে প্রভূত অবদান রাখবে।”

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এ সংকটের টেকসই সমাধান শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, সমগ্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ এবং এই অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির অর্জনের লক্ষ্যে একটি ‘মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক’ অঞ্চল বাস্তবায়নের জন্য সহায়ক।

রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য এ পর্যন্ত জাপান সরকার প্রায় ১৫ কোটি ডলার আর্থিক সহায়তা দিয়েছে বলে গত ডিসেম্বরে এক বিবৃতিতে জানায় জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর। 

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আব্দুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।