রোহিঙ্গা শিবিরে দেড় লাখ মানুষের উপযোগী বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা
2019.01.29
কক্সবাজার ও ঢাকা

ডায়রিয়াসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগব্যাধি ও চর্ম রোগের সংক্রমণ থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে নির্মাণ করা হয়েছে আড়াই একর বিস্তৃত একটি মানব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট।
মঙ্গলবার দুপুরে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালংয়ের ক্যাম্প-৪ এ পাহাড়ি জমিতে স্থাপিত এ প্ল্যান্টটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এনামুর রহমান।
এই প্লান্টটি দেড় লাখ মানুষের বর্জ্য পরিশোধন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিরাট অবদান রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ এর সহযোগিতায় এবং জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর আর্থিক সহায়তায় মানব বর্জ্য ব্যবস্থাপনাটি নির্মাণ করেছে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা অক্সফাম।
দুই কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্ল্যান্টটি বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে এই প্রথম বলে জানিয়েছেন অক্সফাম ও ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তারা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মোহাম্মদ এনামুর রহমান বলেন, “ক্যাম্পে রোগব্যাধির প্রকোপ কমাতে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে এটি করা হয়েছে। যা পরিবেশের কোনো ক্ষতি করবে না।”
তিনি বলেন, “আমাদের বড় বড় মেট্রোপলিটন, সিটিতেও কিন্তু এই ব্যবস্থা নাই। এখানকার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টও অসাধারণ। এটি সফল হলে আমাদের দেশের বিভিন্ন বস্তি এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়ও এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. জাহিদ বেনারকে বলেন, “আমাদের এখানকার পায়খানা প্রায়ই উপচে পড়ে আশপাশে ছড়িয়ে যায়। কখনো কখনো ঘরের কাছে চলে আসে। ওখানেই বাচ্চারা খেলাধুলা করে। টিউবওয়েলের পানিতে দুর্গন্ধ বের হয়।”
তিনি বলেন, “নতুন ট্যাংকিতে ময়লা রাখা গেলে আমরা একটু ভালো থাকি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা যখন এসেছিল তখন আমরা মনে করেছিলাম তারা ছয় মাসের মধ্যে চলে যাবে। সে কারণেই মানব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সেভাবেই করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, “এখন যেহেতু তারা এখানে দীর্ঘ সময় ধরে থাকছে তাই আমরা বড় আকারে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কাজ করছি।”
কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, গত বছর শরণার্থী শিবিরে দুই লাখেরও বেশি মানুষ তীব্র ডায়রিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও স্ক্যাবিসের মতো চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছে।
এই ধরনের সংক্রমণের অন্যতম কারণ হিসাবে নিম্নমানের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করা হয়।
অক্সফামের ওয়াটার ও স্যানিটেশন প্রকৌশলী সালাহ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব কমানোর জন্য নিরাপদ স্যানিটেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দিকটি মাথায় রেখেই মূলত এটি করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এই পরিবেশবান্ধব প্ল্যান্টটি শরণার্থীদের সুস্থ রাখবে।”
তাঁর মতে এখানে প্রতিদিন গড়ে ৪০ কিউবিক মিটার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা যাবে। এ ছাড়া এই প্ল্যান্টটি খুবই সাশ্রয়ী এবং পরিচালন ব্যয়ও অত্যন্ত কম। এবং স্থায়িত্বকাল হবে প্রায় বিশ বছর।
সালাহ উদ্দিন বলেন, “পরিবেশবান্ধব এ প্ল্যান্টটি তৈরি করা হয়েছে, আবৃত পুকুর ও জলাভূমি তৈরি করার মাধ্যমে। তাই, এটি মানুষ ও পরিবেশের জন্য খুবই নিরাপদ। এখানে রয়েছে একাধিক পরিশোধন ধাপ, যা স্থানীয় পানির উৎসকে দূষিত করবে না।”
তিনি বলেন, “তাছাড়া আবৃত থাকার কারণে এই ইউনিট থেকে কোনো দুর্গন্ধও বের হবে না।”
সালাহ উদ্দিন বলেন, জরুরি অবস্থায় বর্জ্য নিষ্কাশনের সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে ট্যাংক ব্যবহার করে বর্জ্যগুলো ল্যাট্রিন থেকে তুলে আনা এবং দূরে নিয়ে ফেলে দেয়া।
তিনি বলেন, “কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, বিশ্বের শতকরা ৮৫ভাগ শরণার্থীই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রয়েছে এবং বাস করছে। এসব ক্যাম্পে প্রায় অপর্যাপ্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকে, যার ফলে অতিরিক্ত বর্জ্য পরিশোধন করা সব সময় সম্ভব হয় না।
তাই ক্যাম্পের মধ্যে যদি এই ধরনের পরিশোধন ব্যবস্থা তৈরি করা যায় তাহলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেকটা কমে আসবে।
ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি স্টিভ করলিস এই প্ল্যান্ট সম্পর্কে বেনারকে বলেন, “এই প্ল্যান্ট স্থাপনের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্যাম্প-এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং স্থায়িত্ব বজায় রেখে রোগ সংক্রমণ কমিয়ে আনা।”
তিনি বলেন, “সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নিরাপদ অপসারণ পরিবেশের দূষণ কমায় এবং রোগ জীবাণুর প্রাদুর্ভাব কমায়।”
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে বাস করছে। এই বিপুল পরিমাণ শরণার্থীদের বেঁচে থাকার জন্য এখনো নিরাপদ খাবার পানি, আশ্রয় এবং অন্যান্য সহায়তা প্রয়োজন।
অক্সফামের কান্ট্রি ডিরেক্টর দীপংকর দত্ত বেনারকে বলেন, সিরিয়া, তুরস্কসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থীরা বাস করছে। বিভিন্ন দেশে শরণার্থী শিবিরে যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্টগুলো আছে, এর মধ্যে এটি হচ্ছে সবচেয়ে বৃহৎ।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ প্রকল্প থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদনের বিষয়টিও আমরা পরীক্ষা করে দেখছি।”