রাখাইনে এক বছরে হত্যার শিকার প্রায় সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গা

কামরান রেজা চৌধুরী ও তুষার তুহিন
2018.02.01
কক্সবাজার
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী মোহাম্মদ করিম বাংলাদেশে আসার আগে নিজের মোবাইল ফোনে সংগ্রহ করা রাখাইনের গণকবরের ভিডিও দেখাচ্ছেন অন্যদের। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী মোহাম্মদ করিম বাংলাদেশে আসার আগে নিজের মোবাইল ফোনে সংগ্রহ করা রাখাইনের গণকবরের ভিডিও দেখাচ্ছেন অন্যদের। ১৪ জানুয়ারি ২০১৮।
AP

জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লির কাছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যায় নিহত প্রায় চার হাজার রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করেছেন রোহিঙ্গা নেতারা। এদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার প্রমাণ’ রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ইয়াংহি লি।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন শেষে ফিরে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের কাছে তিনি এই মন্তব্য করেন।

রোহিঙ্গাদের সরবাহ করা তালিকা সম্পর্কে সরাসরি কিছু না বললেও গতমাসে বাংলাদেশ সফরকালে রাখাইনের সহিংসতায় নিহত অথবা নিখোঁজ ‘অসংখ্য মানুষের নামের তালিকা’ পেয়েছেন বলে জানান লি।

“রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি দল লি র ওপর ‘আস্থা’ রেখে তাঁর কাছে একটি তালিকা হস্তান্তর করেছে,” ঢাকায় বেনারকে বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র।

তবে তিনি এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

হত্যার শিকার সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গা

মিয়ানমার সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ও উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা গত এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দুই দফায় প্রায় ৪ হাজার ৩৪৮ রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে বলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে।

ড. জাফর আলমের নেতৃত্বে ২০ জন রোহিঙ্গার একটি দলের উদ্যোগে জরিপভিত্তিক এই তালিকাটি প্রস্তুত হয়।

গণহত্যা সম্পর্কিত রোহিঙ্গাদের জরিপ প্রতিবেদনের একটি পৃষ্ঠা।
গণহত্যা সম্পর্কিত রোহিঙ্গাদের জরিপ প্রতিবেদনের একটি পৃষ্ঠা।
বেনারনিউজ

২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আল ইয়াক্বীন ও আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার জবাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী, বিজিপি ও উগ্রবাদী বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের ওপর দু’ দফা হামলা চালায়। আর এতেই নিহত হন প্রায় সাড়ে হাজার রোহিঙ্গা।

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো বর্বরতা লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ এই প্রথম। এই তালিকার একটি অনুলিপি বেনারনিউজের কাছে রয়েছে।

“আমাদের দলটি উখিয়া ও টেকনাফে শরণার্থী শিবিরের ঘরে ঘরে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছে এবং তাদের ওপর সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড পুলিশ ও উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নির্যাতনের ভয়াবহ ঘটনাগুলো জেনেছে,” বেনারকে বলেন জাফর আলম।

তবে তথ্য সংগ্রহের সময় উনছিপ্রাং, লেদা, শামলাপুর, ঘুনদুম (১) ও ঘুনদুম (২)—এই পাঁচটি পাঁচটি ছোট শরণর্থী শিবির বাদ পড়েছে বলে জানান জাফর। এই শিবিরগুলোতে শরণার্থীর সংখ্যা এক লাখেরও বেশি।

“আমরা এই শিবিরগুলোয় যাইনি। কারণ এগুলোকে শরণার্থী শিবির হিসেবে সরকার স্বীকৃতি দেয়নি। তাছাড়া, দূরের শিবিরগুলোয় যাওয়ার মতো সুযোগও আমাদের ছিল না,” বলেন জাফর।

“আমাদের দলের সদস্যরা স্বেচ্ছায় কাজটি করেছে। তালিকাটি তৈরির জন্য কেউ আমাদের কোনো অনুদান দেয়নি,” আলম জানান।

জাফর বলেন “আমাদের তালিকা অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরপরই ৩ হাজার ৯৪২জনকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা হত্যা করে। এই হামলাগুলো চালানো হয়েছিল মংডু, রাথেডং ও বুথিডংয়ে।”

তিনি আরও বলেন, কমপক্ষে ৪০৬ জনকে সেনাবাহিনী ও বিজিপি তুলে নিয়ে যায় ও পরে হত্যা করে।

“তার মানে হচ্ছে অক্টোবর ২০১৬ থেকে আগস্ট ২০১৭ সালের মধ্যে তিনটি শহরে ৪ হাজার ৩৪৮ জনকে হত্যা করা হয়,” যোগ করেন তিনি।

রোহিঙ্গাদের তৈরি করা তালিকা অনুসারে মংডু হলো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল। দুটি অভিযানে মংডুতে ২ হাজার ৩৫৪জন নিহত হন। তারপর সেনাবাহিনী ও বিজিপি ২২২জনকে তুলে নিয়ে হত্যা করে।

এতে বলা হয়েছে, শুধু মংডুতেই ১০৬টি গণকবর রয়েছে। ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮৯০টি। রোহিঙ্গাদের ৫৬ হাজার বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

“বিস্তৃত এই তালিকাটি আমরা মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াং লি–কে দিয়েছি। লি গত ২০ জানুয়ারি এখানে পরিদর্শনে এসেছিলেন,” বলেন জাফর আলম।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী মোহাম্মদ করিম বাংলাদেশে আসার আগে নিজের মোবাইল ফোনে সংগ্রহ করা রাখাইনের গণকবরের ভিডিও দেখাচ্ছেন অন্যদের। ১৪ জানুয়ারি ২০১৮।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী মোহাম্মদ করিম বাংলাদেশে আসার আগে নিজের মোবাইল ফোনে সংগ্রহ করা রাখাইনের গণকবরের ভিডিও দেখাচ্ছেন অন্যদের। ১৪ জানুয়ারি ২০১৮।
AP

 

রাখাইনে ৫টি নতুন গণ-কবরের সন্ধান

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ৫টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছ বলে বৃহস্পতিবার ভিডিওসহ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তসংস্থা এপি।

ঘটনার সাক্ষী ২৪ জন রোহিঙ্গা ও নিহতদের আত্মীয় স্বজনের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের মোবাইল ফোনে রেকর্ড করা গণকবরের ভিডিওচিত্রও প্রকাশ করে এপি।

এতে বলা হয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অন্তত ৪০০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করে ওইসব গণকবরে মাটিচাপা দেয়।

এপির প্রতিবেদনে গণহত্যাটি আগস্টের ২৭ তারিখ সংঘটিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়েছে।

এতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বলা হয়, ওই দিন সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা গ্রামে আক্রমণের সময় অন্যান্য অস্ত্রপাতি ও কবর খোঁড়ার সরঞ্জামের সাথে এসিডও নিয়ে এসেছিল।

হত্যাকাণ্ডের পর মৃতদেহগুলোর মুখ ও হাত তারা এসিডে পুড়িয়ে দেয়, যাতে পরবর্তীতে কোনোভাবে নিহতদের শনাক্ত করা না যায়।

এর আগে মেডিক্যাল সান্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল যে, গত আগস্টে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন শুরুর প্রথম মাসেই অন্তত ৬ হাজার ৭০০ জনকে হত্যা করে।

এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে, গা দার পিয়ান গ্রামের গণহত্যা সম্পর্কে সুনির্দষ্ট তথ্য না থাকলেও একে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দ্বারা পূর্বে সংগঠিত "একই ধরনের" ঘটনা বলে মন্তব্য করেন ইয়াংহি লি।

ঘটনাগুলোকে “মানবাতার বিরুদ্ধে সীমাহীন অপরাধ” হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এগুলো এমন সব ঘটনা, যার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।”

এদিকে রাখাইনে সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের ফলে নতুন গণকবর উদঘাটনে “খুবই মর্মাহত” বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

এ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হেদার নুয়ার্ট বলেন, “গণকবরগুলোর প্রতিবেদন দেখে আমরা খুবই, খুবই মর্মাহত।”

ঘটনাগুলো যুক্তরাষ্ট্র নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে জানিয়ে সহিংসতায় যুক্তদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র সচেষ্ট রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, এর আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনী মাত্র দশজন রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছিল। তবে তাঁরা দাবি করেছিল নিহতরা সকলেই ‘সন্ত্রাসী’।

গত আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ‘জাতিগত নিধন’ শুরু করার পর এখন পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের দেশটির নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।