মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান: বাংলাদেশের মতে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়বে না

জেসমিন পাপড়ি ও আবদুর রহমান
2021.02.01
ঢাকা ও কক্সবাজার
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান: বাংলাদেশের মতে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়বে না মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ও দেশটির নির্বাচিত নেত্রী অং সান সুচির গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে থাইল্যান্ডে মিয়ানমার দূতাবাসের সামনে প্রবাসী বার্মিজদের বিক্ষোভ। ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
[জিতিমা লুকবুন/বেনারনিউজ]

অং সান সুচিসহ নির্বাচিত নেতাদের সরিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার আহ্বান জানিয়ে দেশটির সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে বলে সোমবার আশা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। 

গত নভেম্বর মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনের অং সান সুচির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও জালিয়াতির অভিযোগ তোলে সেনাবাহিনী। 

সোমবার নব-নির্বাচিত সংসদের প্রথম বৈঠক হবার কথা ছিল। কিন্তু ওই দিন ভোরেই মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট, নির্বাচিত নেত্রী সুচি এবং তাঁর দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের আটক করে দেশটিতে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সেনাবাহিনী।

বর্তমানে দেশটির ক্ষমতা সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিং অং হ্লাইংয়ের হাতে অর্পণ করা হয়েছে বলে অভ্যুত্থানের পর জানানো হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে।

“বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে গণতন্ত্রের চেতনায় বিশ্বাস করে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন দেয়। আমরা আশা করব, মিয়ানমারেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখা হবে,” বলা হয় সোমবারের বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে।

এতে বলা হয়, “বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছামূলক, নিরাপদ এবং টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করে আসছি। আমরা চাই সেই প্রক্রিয়া যেন অব্যাহত থাকে।”

তবে বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

“মিয়ানমারে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আপাতদৃষ্টিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে যতটুকু অগ্রগতি হয়েছিল, তা পুরোপুরি থমকে গেল,” বেনারকে বলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন আহমেদ।

এই কূটনীতিকের মতে, মিয়ানমার এখন ‘অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি’ সামাল দেবার কথা বলে প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করবে।

“মিয়ানমারে অনেক বছর ধরে সামরিক শাসন চলছে। এটা দেশটির জন্য নতুন কিছু না,” মন্তব্য করে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “চীন, ভারত, রাশিয়াসহ তাদের বন্ধু দেশগুলোও তাদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করবে না।”

“কিন্তু বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা যাওয়ার প্রক্রিয়াটা ধাক্কা খেলো, বলেন তিনি। 

BD-Rohingya_rex_my.jpg
টেকনাফের শরণার্থী শিবিরে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ও অং সান সুচি গ্রেপ্তারের খবর মুঠোফোনে দেখছেন বাংলাদেশে আশ্রিত এক রোহিঙ্গা। ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১। [আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

রোহিঙ্গাদের জন্য ‘হয়তো ভালো হতে পারে’

টেকনাফ লেদা শরণার্থী শিবিরের নেতা মোস্তফা কামালের মতে, সেনা অভ্যুত্থানের কারণে মিয়ানমারে পরিস্থিতি অশান্ত থাকবে, যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে “বড়ো বাধা হয়ে দাঁড়াবে।”

তবে শরণার্থীদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের নেতা সৈয়দ উল্লাহ’র মতে, দেশটিতে সেনা অভ্যুত্থান “হয়তো রোহিঙ্গাদের জন্য ভালো হতে পারে।”

তিনি বলেন, “সামরিক বাহিনীর আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন, তাই রাজনৈতিকভাবে সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা ইস্যুতে মনোনিবেশ করতে পারে। সেই দিকটা আমাদের জন্য ভালো হতে পারে।”

প্রায় একই মত দেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন।

মিয়ানমারে “বহু বছর ধরেই সামরিক শাসন। ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সাথে যখন রোহিঙ্গারা ফেরত যায় তখনও সামরিক শাসন,” ছিল মন্তব্য করে সোমবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “সামরিক শাসনেরই বরং তাঁরা সহজে প্রত্যাবাসিত হয়েছে।”

“আমরা সরকারের সাথে আলোচনা করি। ব্যক্তি বিশেষের সাথে না। সুতরাং মিয়ানমার সরকারের সাথে আমাদের আলোচনা চলমান থাকবে,” জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমাদের বিশ্বাস আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করব।” 

এদিকে সেনা অভ্যুত্থানের পর নতুন করে যাতে কেউ অবৈধ অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) বিজিবির কর্মকর্তারা। 

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন। এর আগে আরো প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ছিলেন। সব মিলিয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করছেন। 

মিয়ানমার সরকার ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি সই করে। তবে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। 

পশ্চিমে কড়া নিন্দা, প্রতিবেশীদের প্রতিক্রিয়া সাদামাটা

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনায় জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলো থেকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ উচ্চারিত হলেও প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে প্রতিক্রিয়ার ধরন খুব সাদামাটা।

মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এটিকে “গণতন্ত্রায়ণ ও আইনের শাসনের ওপর সরাসরি আঘাত,” বলে আখ্যায়িত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

সোমবার হোয়াইট হাউস থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জো বাইডেন বলেন, “বার্মায় সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল, অং সান সুচিসহ বেসামরিক নেতৃবৃন্দকে আটক এবং দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা দেশটির গণতন্ত্রায়ণ ও আইনের শাসনের ওপর সরাসরি আঘাত।”

“গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের আকাঙ্ক্ষা দমন অথবা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ফলাফল বাতিলে বলপ্রয়োগ কখনোই পন্থা হতে পারে না,” মন্তব্য করে বিবৃতিতে তিনি বলেন, “প্রায় এক দশক ধরে বার্মার জনগণ নির্বাচন, বেসামরিক সরকার গঠন এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করার জন্য অব্যাহতভাবে কাজ করে গেছেন। অগ্রগতির সেই ধারাকে অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে।”

সোমবার ক্ষমতা দখলকারী সিনিয়র জেনারেল মিং অং হ্লাইং ২০১১ সাল থেকেই মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান। রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যায় সংযুক্ততার অভিযোগে ২০১৯ সালে তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। 

সেনা অভ্যুত্থানকে “গণতান্ত্রিক সংস্কারের ওপর কঠিন আঘাত,” হিসেবে উল্লেখ করে সুচিসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

একইভাবে অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে আটক রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। 

অন্যদিকে মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের মিত্র ও প্রতিবেশী চীন-ভারত অভ্যুত্থানের কোনো নিন্দা না করেই আশা প্রকাশ করেছে দেশটিতে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন অব্যাহত থাকবে।

মিয়ানমারের ‘পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ’ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ভারত এবং ‘পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে নজর রাখা’র কথা জানিয়েছে চীন।

মিয়ানমার দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) এর সদস্য।

কিছু আসিয়ান সদস্য মিয়ানমারের ঘটনাকে দেশটির ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে মন্তব্য করেছে। কেউ কেউ প্রত্যাশা করেছে শান্তি ও স্থিতিশীলতা।

তবে আসিয়ানে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানকে ‘আসিয়ান নীতিমালার লঙ্ঘন’ ও দেশটির গণতন্ত্রায়ণের জন্য ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছেন।

একইভাবে ব্রুনাই থেকে প্রকাশিত আসিয়ান চেয়ারম্যানের বিবৃতিতে মিয়ানমাররে শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রত্যাশা করা হয়। 

নিজেদের দীর্ঘ সামরিক শাসনের ঐতিহ্য থাকা মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড অভ্যুত্থানের ঘটনাটিকে দেশটির ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে মন্তব্য করেছে। একই ধরনের মন্তব্য করেছে ফিলিপাইন। 

মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া প্রত্যাশা করেছে দেশটিতে ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা।’

 প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কুয়ালালামপুর থেকে হাদি আজমি ও নোয়া লি, ব্যাংকক থেকে নানতারাত পাইচারোয়েন ও উইলাওয়ান ওয়াচারাসাকেত, ম্যানিলা থেকে ডেনিস জে সান্তোস, ও জাকার্তা থেকে আহমেদ শামসুদ্দিন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।