ভাসানচর যাবার জন্য রোহিঙ্গাদের চাপ দেয়া হচ্ছে, অভিযোগ মানবাধিকার সংগঠনের
2022.02.01
ঢাকা

রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করার জন্য নির্যাতন ও ভয় দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ফর্টিফাই রাইটস।
নির্যাতন করে বা হুমকি দিয়ে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নেবার স্বপক্ষে তাদের হাতে পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে বলে রোববার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে দাবি করেছে সংগঠনটি।
“ফর্টিফাই রাইটস’র হাতে আসা ভিডিও ও বক্তব্যগুলো এটাই উন্মোচিত করে যে, জোরপূর্বক হস্তান্তরের পাশাপাশি পরিবারগুলোকে বিচ্ছিন্নও করা হচ্ছে,” বলা হয় বিবৃতিতে।
“শরণার্থীদের অধিকারের বিষয়টিকে এড়িয়ে যেভাবে তাঁদেরকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হচ্ছে এটা অপমানজনক। বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার উচিত শরণার্থীদের অধিকার রক্ষায় সচেতন থাকা,” বিবৃতিতে বলেন ফর্টিফাই রাইটসের আঞ্চলিক পরিচালক ইসমাইল উলফ।
“গণহত্যা থেকে রক্ষা পাওয়া এই মানুষগুলোর সঙ্গে এই ধরনের আচরণ অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং অমানবিক। সকল মানবাধিকার এবং মানবিক উদ্বেগের বিষয়গুলো সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এবং সম্মতি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সরকারের উচিত দ্বীপে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর বন্ধ রাখা,” বলেন উলফ।
নির্যাতনের দাবি ‘ভিত্তিহীন’
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় এ পর্যন্ত কক্সবাজার থেকে প্রায় ২১ হাজার রোহিঙ্গা ভাসানচর গেছেন, যাদের মধ্যে দুই হাজারের বেশি গেছেন গত অক্টোবরে বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার মধ্যে ভাসানচর পরিচালনা ইস্যুতে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের পর।
সর্বশেষ গতকাল সোমবার উখিয়া থেকে এক হাজার ২৮৭ জনের একটি রোহিঙ্গা দল নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার ভাসানচরে পৌঁছেছেন। সরকারের লক্ষ্য সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরিত করা।
তবে নির্যাতন করে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরের হস্তান্তর করা হচ্ছে ফর্টিফাই রাইটসের এই দাবিকে পুরোপুরি ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ্ রেজওয়ান হায়াত।
তিনি বলেন, “এটা কোনোভাবেই সত্য হতে পারে না। জোরপূর্বক বা নির্যাতন করে কাউকে পাঠালে এতদিনে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আরো অনেক বেশি থাকত।”
“এখানে বহু এনজিও, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সকল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এই ধরনের অভিযোগ স্থানীয়ভাবে কেউই করছে না,” বলেন তিনি।
বিদেশ থেকে বিষয়টি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে হয়ে থাকতে পারে ধারণা করে এই কর্মকর্তা বলেন, “আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করবে আপনারা নিজেরা এসে বা নিজেদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে যাচাই বাচাই করতে পারেন।”
ফর্টিফাই রাইটসের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চেয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এর স্থানীয় প্রতিনিধিকে ইমেইল পাঠিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
ভাসানচরে ‘পরিবার বিচ্ছিন্ন শিশুও রয়েছে’
বিবৃতিতে সংগঠনটি কয়েকজন ভুক্তভোগীর বক্তব্য ও কয়েকটি বৈঠকের বিষয়ে জানায়, যেখানে বলা হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর হতে উপুর্যপুরি চাপ প্রয়োগ করছে, কোনো কোনো রোহিঙ্গা নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, ফর্টিফাই রাইটস কক্সবাজারের আট ও ভাসানচরের দুইজন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছে, যাদের মধ্যে তিনজন রোহিঙ্গা নেতা বা মাঝি রয়েছেন, যারা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর প্রসঙ্গে গত বছর সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
এর বাইরেও ফর্টিফাই রাইটস সরকার নিয়োজিত একজন ক্যাম্প ইনচার্জ, একজন ইউএন’র প্রতিনিধি ও একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ধারণ করা মোবাইল ভিডিও বিশ্লেষণ করেছে বলে জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।
এতে বলা হয়, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এক রোহিঙ্গাকে মারধর করে তাঁর পরিবারের পরিচয়পত্র কেড়ে নেয়। তারপর তাঁকে তাঁর পরিবার থেকে আলাদা করে জোরপূর্বক ভাসানচর পাঠিয়ে দেয়।
“সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই ব্যক্তি রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরিত হবার ক্ষেত্রে বাধা দিয়ে আসছিল,” বলা হয় বিবৃতিতে।
ওই শরণার্থীর স্ত্রী ফর্টিফাই রাইটসকে জানান, “ভাসানচরে পাঠানোর আগে তাঁর স্বামী তাঁকে জানিয়েছেন যে, প্রশাসনের লোকেরা তাঁকে চোখ বেঁধে নির্যাতন করেছে।”
“আমি আমার স্বামীর চেহারায় নির্যাতনের চিহ্ন দেখেছি। আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই এবং আমি ভাসানচর যেতে চাই না,” বলেন ওই নারী।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রেজওয়ান হায়াত বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা তাঁর জানা নেই।
এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত মাসে ভাসানচরের ওপর জাতিসংঘের একটি যৌথ মূল্যায়ন সংক্রান্ত গোপন প্রতিবেদন ফর্টিফাই রাইটসের হাতে এসেছে, যেখানে দেখা গেছে, ভাসানচরে চলাচলের স্বাধীনতা না থাকা নিয়ে এবং পরিবারগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
“বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া পরিবারগুলো নানাভাবে চেষ্টা করছে কক্সবাজারে থাকা তাঁদের পরিবারের সাথে সম্পর্ক ধরে রাখতে। কখনো কখনো পরিবারের সদস্যদের কাছে ফেরত যাওয়ার ইচ্ছা থেকে তারা বিপদজনক যাত্রা করে এবং আইনি সহায়তা ছাড়াই কারাগারে নিক্ষেপিত হয়,” বলা হয় বিবৃতিতে।
দ্বীপে সঙ্গহীন এবং পরিবার বিচ্ছিন্ন শিশুও রয়েছে বলে জানানো হয় বিবৃতিতে।
রেশন ও চিকিৎসা ব্যবস্থা ‘খুবই খারাপ’
উখিয়া কুতুপালং শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গা মাস্টার জহিরুল ইসলাম পরিবার নিয়ে ২০২০ সালে ২৮ ডিসেম্বর উন্নত জীবনের আশায় ভাসানচরে স্বেচ্ছায় পাড়ি জমান। কিন্তু পৌঁছার পরে দেখেন ভিন্ন চিত্র।
“এখানে রেশন ও চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই খারাপ। মানুষ এখানে কীভাবে থাকবে। শুধু ইটের ঘর-বাড়িতে রাত্রি যাপন করলে কি জীবন চলে? আমি এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। যারা ভাসানচর থেকে পালিয়ে যাবার সময় ধরে পড়ে, তাদের ব্যাপক মারধর করে। এসব দেখে আর পালানোর চেষ্টা করছি না। এক কথায় পুরো পরিবারসহ আমরা এখানে ‘বন্দি’ জীবন পার করছি,” বেনারকে বলেন জহিরুল।
টেকনাফের হ্নীলার আলীখালী ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. নুর বেনারকে জানান, তার আশ-পাশ ক্যাম্প থেকে বেশ কিছু রোহিঙ্গা ভাসানচরে গেছেন। সেখানে তাঁর স্বজনও রয়েছেন।
তিনি বলেন, “তাদের সঙ্গে আমাদের ফোনে কথা হয়। ভাসানচরে তারা ভালো নেই।”
“মাঝিদের প্রতি কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা রয়েছে প্রত্যেক ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে লোক পাঠাতে হবে। এর জন্য ভাসানচরে যেতে রাজি না হলে, অনেক ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগ করা হয় লোকজনের প্রতি,” অভিযোগ করেন তিনি।
মিয়ানমারের সেনাদের অভিযান থেকে প্রাণে বাঁচতে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাস করছেন। এদের বেশিরভাগই ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নৃশংস অভিযানের সময়ে এসেছিলেন।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে কক্সবাজার থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান।