রোহিঙ্গা গণহত্যা: আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার বিষয়ে আপত্তি তুলে নিলো মিয়ানমারের ছায়া সরকার
2022.02.02
ঢাকা ও কক্সবাজার

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে ঘটা গণহত্যার বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এখতিয়ার রয়েছে বলে জানিয়েছে সেদেশের সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতাচ্যুত অং সান সূ চি’র ছায়া সরকার, ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)।
তবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অং সান সূ চি নিজে হাজির হয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ গণহত্যা নয় এবং এর বিচার করার এখতিয়ার এই আদালতের নেই।
গত বছর পহেলা ফেব্রুয়ারি সেনা প্রধান জেনারেল অং মিন লাইং এর হাতে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার ব্যাপারে অবস্থান পরিবর্তন করেছে সূ চি’র দল।
দলটি আদালতে দেয়া আপত্তি তুলে নিয়েছে বলে বুধবার জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি সূ চি‘র দলের একটি ‘সুবিধাবাদের’ রাজনীতি হলেও এই অবস্থান পরিবর্তনের ফলে জান্তা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর একটি সম্ভাবনা তৈরি হবে।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ছায়া সরকারের এই অবস্থান পরিবর্তন ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন।
এই আপত্তি প্রত্যাহারের কয়েকদিন আগেই এক বছর পর বাংলাদেশের সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে অনলাইন সভায় মিলিত হয় মিয়ানমারের জান্তা সরকার।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস এর সাধারণ সম্পাদক মাস্টার মো. জুবায়ের বুধবার বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার নিয়ে অং সান সু চি’র জাতীয় সরকারের যে বিরোধিতা বা আপত্তি ছিল, তা প্রত্যাহার করায় আমরা মনে করছি এ বিচারের রায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে আসবে। এর ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী যে ধারাবাহিকভাবে নির্যাতন, নিপীড়ন বা গণহত্যা চালিয়ে আসছিল তা আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণিত হবে।”
তিনি বলেন, “মামলার রায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে গেলে এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ালে হয়তো যুগ যুগ ধরে চলে আসা নির্যাতন বন্ধও হতে পারে।”
“তবে বর্তমান সেনা সমর্থিত সরকার কোনোদিন রোহিঙ্গাদের মেনে নেবে না,” বলেন জুবায়ের।
রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলার ওপর মিয়ানমারের জাতীয় সরকারের আপত্তি তুলে নেওয়ার বিষয়টি রোহিঙ্গাদের জন্য ইতিবাচক জানিয়ে বান্দরবানের ঘুমধুম কোনারপাড়া নো মেনস ল্যান্ডে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নেতা দীল মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “এতে বিচার প্রক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত হবে। এমনকি সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ মামলায় রোহিঙ্গারা বিচার পাবে।”
“তবে বিচারের রায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে এলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সোচ্চার না হলে রোহিঙ্গারা কোনো দিনও নিজ দেশে ফিরতে পারবে না। কারণ গণহত্যার বিচারের রায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে গেলে বর্তমান সেনা সমর্থিত সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আরও সক্রিয় হবে। এতে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন আরও বাড়বে,” বলেন তিনি।
সংশয় রয়ে গেছে
সূচি সমর্থিত জাতীয় সরকার রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারে আপত্তি তুলে নিলেও তাদের এ সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গাদের পক্ষে কতটুকু আসবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাসরত আরেক রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ নূর।
তিনি বলেন, “অনেকে বলছেন এটা তাদের একটা কৌশলও হতে পারে।”
“তবে আইন আইনের গতিতে চললে এ বিচারের রায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে আসবে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায় আন্তরিকভাবে চাইলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান সম্ভব। রোহিঙ্গারা দেশে ফিরে যেতে পারবে।”
ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট মূলত অং সান সূ চি’র রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) এর সর্বশেষ নির্বাচনে নির্বাচিত সাংসদ ও অন্যান্যদের নিয়ে গঠিত বলে বেনারকে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এর সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ আহমাদ।
“গতবছর ফেব্রুয়ারি মাসে সামরিক সরকার তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার পর তারা ছায়া সরকার গঠন করেছে, যার নাম দিয়েছে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “এই ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট নিজেদের বৈধ সরকার বলে দাবি করে সারাবিশ্বে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে তারা সকল প্রকারের প্রচারণা করে যাচ্ছে।”
যেহেতু মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা সরকার আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করতে পারছে না, সেহেতু আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট, জানিয়ে মুনশি ফায়েজ বলেন, “সেকারণে তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দেয়া আপত্তি তুলে নিয়ে বলছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে গণহত্যা হয়েছে তা বিচারের বিষয়ে এই আদালতের এখতিয়ার আছে।”
“কিন্তু সারাবিশ্ব দেখেছে, এনএলডি প্রধান অং সান সূ চি কীভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চালানো সামরিক বাহিনীর গণহত্যার বিচারের ব্যাপারে এখতিয়ার নেই বলে বক্তব্য দিয়েছেন,” বলেন তিনি।
তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যা বিষয়ে তাদের আপত্তি তুলে নেয়া সংক্রান্ত বক্তব্য “বিশ্বাস করা কঠিন।”
তিনি বলেন, “আবার যদি সামরিক বাহিনীকে তারা হটাতে পারে এবং তারা ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে হয়তো অবস্থান পরিবর্তন করবে।”
মিয়ানমার সীমান্তরক্ষা বাহিনীর ওপর আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন ফ্রন্ট (আরসা) এর সশস্ত্র আক্রমণের জবাবে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট নর্দার্ন রাখাইন রাজ্যে সমগ্র সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও জঙ্গি বৌদ্ধরা।
কয়েকদিনের মধ্যে রাখাইন থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয় যা আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ ও গণহত্যার সামিল।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত এই অপরাধের প্রতিকার চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করে গাম্বিয়া।
তখনকার সূ চি সরকার এই মামলার বিরোধিতা করে জানায়, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দায়ের করা গণহত্যার বিচার করার এখতিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নেই। কারণ, মিয়ানমার এই চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশ নয়।
তবে প্রসিকিউশনের মতে, মিয়ানমার স্বাক্ষরকারী দেশ না হলেও এই গণহত্যার বিচার করার এখতিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রয়েছে।