মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বর্ণনা শুনে মর্মাহত অ্যাঞ্জেলিনা জোলি
2019.02.05
কক্সবাজার ও ঢাকা

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বর্ণনা শুনে মর্মাহত হলিউড অভিনেত্রী ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার বিশেষ দূত অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।
বাংলাদেশ সফরের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার কক্সবাজারের উখিয়ার মধুছড়ায় সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। তিনি সোমবার টেকনাফ ও মঙ্গলবার উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে মিয়ানমারে তাঁদের ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা শোনেন।
জোলি বলেন, মিয়ানমার তাঁদের নাগরিকত্বসহ নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত না করলে রোহিঙ্গারা সে দেশে ফিরে যাবে না।
রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করারও আশ্বা দেন তিনি। তাঁর মতে, রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে মাঠ পর্যায়ে তেমন কিছু করা হয়নি।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে জোলি সাংবাদিকদের বলেন, “সকল শরণার্থীই ঝুঁকিতে থাকেন। কিন্তু রোহিঙ্গারা শুধু বাস্তচ্যুত নয়, তাঁরা রাষ্ট্রহীন। তাঁদের নাগরিকত্বের মতো মৌলিক মানবাধিকারটি কেড়ে নেয়া হয়েছে। তাঁদের রোহিঙ্গা নামেও ডাকা হয় না।”
তিনি বলেন, “কিছু পরিবারের সাথে মিলিত হয়েছি, যারা বলেছেন তাঁরা সারাজীবন নিপীড়ন ও রাষ্ট্রহীনতার শিকার হয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, তাঁদের সাথে ‘পশুর মতো’ ব্যবহার করা হতো। এটি শুনে আমি খুবই মর্মাহত।”
জোলি আরও বলেন, মিয়ানমার থেকে যত রোহিঙ্গাকে বাস্তচ্যুত করে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করা হয়েছে, তাঁদের সংখ্যা মিয়ানমার ও সারাবিশ্বে যত রোহিঙ্গা আছে তার দ্বিগুণ।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে উদারতা ও মানবতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশের ওপর না দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মতে, সকল শরণার্থীর মতো রোহিঙ্গারাও দেশে ফিরে যেতে চায় এবং তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার অধিকার আছে। তবে তখনই তারা স্বেচ্ছায় ফিরে যাবে যখন তারা নিরাপদ মনে করবে এবং যখন তাদের অধিকারকে সম্মান দেখানো হবে।
তিনি বলেন, “আমি ধর্ষণের শিকার এক রোহিঙ্গা নারীকে প্রশ্ন করেছিলাম, সে ফিরে যাবে কি না। উত্তরে সে আমাকে জানায়, তার অধিকার নিশ্চিত না করা হলে সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে তাকে গুলি করে মেরে ফেললেও মিয়ানমারে ফিরে যাবে না।”
জোলি বলেন, “রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব মিয়ানমার সরকার ও সেদেশের কর্তৃপক্ষের। আমি আশা করি এ বিষয়টি উপলদ্ধি করবেন। আমরা রোহিঙ্গাদের ছেড়ে যাব না।”
এই হলিউড তারকা বলেন, “রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ ও বাস্তচ্যুতি থামাতে এবং রোহিঙ্গাসহ সেখানকার সকল সম্প্রদায়ের অবস্থা উন্নয়নের জন্য সত্যিকারের আন্তরিকতা প্রদর্শনের আহ্বান জানাই।”
রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি বলেন, “রাষ্ট্রহীনতার গ্লানি ঘোচানোর অধিকার আপনাদের আছে। আপনাদের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তা আমাদের সবার জন্য লজ্জার। কারণ, এটা চার দশকের নৃশংসতা আর বঞ্চনার ফল, যার সুরাহা দীর্ঘ দিনেও হয়নি।”
রাখাইন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পাশাপাশি যারা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।
তাঁর মতে, একটি ব্যাপকতর সমস্যার প্রতীকী বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। তবে বৃহত্তর স্বার্থে সারা বিশ্বের জনগণ, সমাজ একসঙ্গে সাড়া দিয়েছে, তা একটি শক্তির দিকও বটে।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলির বক্তব্যকে রোহিঙ্গাদের ‘মনের কথা’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন শরণার্থীরা।
লাম্বারশিয়া ক্যাম্পের নেতা মাসুদ আরাকানি বেনারকে বলেন, “আমরা সবাই দেশে যেতে চাই। তবে আমাদের নাগরিকত্ব না দিলে আমরা যাব না। আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এখন আমরা সেখানে গেলে মিলিটারি ও মগেরা আমাদের না খাইয়ে মারবে।”
তিনি বলেন, “এখানে বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘ দেখাশোনা করছে। ওখানে ওরা যা ইচ্ছা তাই করবে। তারা একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে থাকতে দেবে না। আমাদের ধর্মের কারণে ওরা আমাদের ধ্বংস করে দিতে চায়।”
মঙ্গলবার সকাল থেকে জোলি কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন শিশুকেন্দ্র, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। পাশাপাশি শিশুসহ রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেন ও তাঁদের দুর্দশার কথা শোনেন।
এসময় ‘ইউএনএইচসিআর’সহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন এনজিও সংস্থার প্রতিনিধিরা তাঁর সাথে ছিলেন।
বিকেলে ব্রিফিং শেষে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ত্যাগ করেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। তিন দিনের বাংলাদেশ সফরের শেষ দিন, বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সাথে দেখা করার কথা রয়েছে তাঁর।