রোহিঙ্গাদের নির্জন দ্বীপে স্থানান্তরের পক্ষে–বিপক্ষে মত

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2017.02.07
কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প, উখিয়া। জানুয়ারি ১৪, ২০১৭।
জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ

কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে একটি দ্বীপে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। বিষয়টি বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কূটনীতিকদের জানিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা চেয়েছে সরকার।

তবে কূটনীতিকরা বলছেন, বিষয়টি সম্পর্কে এখনো তারা পরিষ্কার নন।

সরকারের এ সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। নির্ধারিত স্থানটি বসবাসযোগ্য নয় উল্লেখ করে তাঁরা বলছেন, নির্জন ওই দ্বীপে পুনর্বাসন রোহিঙ্গাদের জীবিকা নির্বাহকে কঠিন করে তুলবে। এ ছাড়া উদ্যোগটি দেশের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

তবে অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে বসবাসযোগ্য করেই নিবন্ধিত অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের আশ্বাস দিয়েছে সরকার।

অবকাঠামো নির্মাণের পর স্থানান্তর

সরকারি তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় চার লাখেরও বেশি। প্রায় চার শ একর জায়গা জুড়ে তারা বসবাস করছে। তবে স্থানীয় পরিবেশবিদরা বলছেন, অন্তত এক হাজার একর জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা।

সরকার বলছে, এই বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন শহর কক্সবাজার ও এর আশপাশের এলাকায় আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক এবং পরিবেশ ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আর এ কারণেই কক্সবাজার এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার দ্বীপ ঠেঙ্গারচরে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

গত রোববার এ বিষয়টি বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের জানিয়ে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাঁদের সহযোগিতা চান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “৬০ টি দেশের কূটনীতিক, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলো তুলে ধরেন ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি জানান, কক্সবাজারের শরণার্থীশিবির ও অস্থায়ী বসতিতে চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এদের মধ্যে গত কয়েক মাসে এসেছে ৬৯ হাজার।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনীতিকদের বলেন, “মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ঠেঙ্গারচরে তাদের স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। এটি একটি সাময়িক ব্যবস্থা। বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে স্থায়ীভাবে প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অর্থবহ উদ্যোগ নেবে।”

ঠেঙ্গারচর বসবাস উপযোগী জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “সরকার সেখানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো যেমন আশ্রয়কেন্দ্র, স্কুল, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।”

তবে চরের উন্নয়ন ও রোহিঙ্গা স্থানান্তরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা প্রয়োজন উল্লেখ করে মাহমুদ আলী বলেন, “ঠেঙ্গারচরে অবকাঠামো ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হওয়ার পরই নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত সব রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করা হবে।”

রোহিঙ্গাদের ঘিরে মানব ও মাদক পাচারকারীচক্রের বিকাশ ঘটেছে বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

বিজ্ঞপ্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, “রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পর বাংলাদেশকে এটি বাস্তবায়নে সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ করে কূটনৈতিক সম্প্রদায়। এ সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে বলে মত দেন তাঁরা।”

নিরাপত্তার জন্য হুমকি

বিশ্লেষকেরা একে সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপে ভিনদেশের নাগরিকদের অবস্থান দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন তাঁরা।

রোহিঙ্গারা পাহাড় ও বন ধ্বংস করছে অভিযোগ আনলেও সেভ দ্যা ন্যাচার, বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের হাতিয়ার দ্বীপে পুনর্বাসন করলে সেখানে তাঁরা স্বাধীন ও স্থায়ী বসতির স্বপ্ন দেখবে। ওই নির্জন দ্বীপে রোহিঙ্গারা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।”

“তা ছাড়া তাঁদের যে জায়গা থেকে তুলে নিয়ে পুনর্বাসন করা হবে, সেই জায়গাতেও নতুন করে রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নেবে। এটা চক্রাকারে চলতে থাকবে,” যোগ করেন তিনি।

মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, “সারা বিশ্বে জঙ্গিবাদ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাদের অর্থ নাই, বিত্ত নাই, শিক্ষা নাই, সেই মানুষগুলোকে প্ররোচিত করে জঙ্গিবাদে যুক্ত করা কোনো বিষয়ই নয়। অতীতেও রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হয়েছে।”

তাই স্থানান্তর নয়, দেশে ফেরত পাঠানোই রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান বলে মন্তব্য করেন মোয়াজ্জেম হোসেন।

বেনারকে বলেন, “এটা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ হবে না। কারণ, যে স্থানটি নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি অত্যন্ত বিপদসংকূল জায়গা। জমি এখনো পানির নিচে, সাইক্লোন, বন্যার আঘাতও নিয়মিত। নতুন জেগে ওঠা চরে অবকাঠামো নির্মাণও সহজ হবে না।”

তিনি বলেন, “মাত্র ৩৫ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গার দায়িত্ব সরাসরি সরকার গ্রহণ করেছে। বাকিরা নিজেরাই ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে। নির্জন দ্বীপে নেওয়া হলে চার লাখের দায়িত্বই সরকারকে নিতে হবে। সেই সামর্থ্য সরকারের রয়েছে কিনা কিংবা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী নিতে পারবে কিনা সে প্রশ্ন থেকে যায়।”

বিষয়টি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে: পশ্চিমা কূটনীতিক

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের পাশে থাকলেও ঠেঙ্গার চরে স্থানান্তর নিয়ে এখনই মতামত দিতে রাজি নয় বিদেশি কূটনীতিকরা। প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে এখনো আরও বিস্তারিত জানতে আগ্রহী তাঁরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদুন বেনারকে বলেন, “সরকার আমাদের অনানুষ্ঠানিকভাবে ঠেঙ্গার চরের বিষয়টি জানিয়েছে। বিষয়টি এখনো প্রাথমিক অবস্থায় আছে। তবে আমরা এ বিষয়ে আরও জানতে চাই। স্থানটি দেখতে চাই।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বেনারকে বলেন, “সরকার যাই করুক না কেন রোহিঙ্গাদের সম্মতিতেই তা করতে হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।